করোনা মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংগীতাঙ্গনের মানুষরা। হাতেগোনা দু-চারজন তারকা শিল্পী ছাড়া কেউই ভালো ছিল না গোটা বছর। প্রায় ৮ মাস স্টেজ শো, নতুন রেকর্ডিং বন্ধ থাকায় এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। এই তালিকায় ছিল সেশন মিউজিশিয়ান, ইভেন্ট অর্গানাইজার, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারসহ স্টুডিও ক্রু। একইসঙ্গে নতুন গান প্রকাশের সংখ্যাও কমেছে বছরজুড়ে।
এদিকে শ্রোতাপ্রিয় শিল্পীদের গান কাভার করা নতুন প্রজন্মের শিল্পীর সংখ্যা বেড়েছে। বছরের শেষের দিকে কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী কনসার্টে অংশ নিতে শুরু করেছেন। তবে সবকিছু মিলিয়ে সংগীতাঙ্গনের অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। চলতি বছরে কণ্ঠশিল্পীদের গানের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই ছিল সীমিত। সংগীতে সারাবছরের আলোচিত-সমালোচিত কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো—
ভিউয়ের দৌড়ে এগিয়ে থাকা গান
জানুয়ারির প্রথমদিকে প্রকাশিত হয় মিনারের ‘কেউ কথা রাখেনি’ শিরোনামের একটি গান। গানটির ভিউ বর্তমানে দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল শিল্পীর নিজেস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। কণ্ঠশিল্পী মনির খানের ‘অঞ্জনা ২০২০’ গানটি ইউটিউবে শ্রোতারা শুনেছেন ১ কোটির বেশি বার। গানটির কথা ও সুর করেছেন মিল্টন খন্দকার। একইসঙ্গে নিজের ক্যারিয়ারের ২৫ বছরপূর্তির ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানটিও প্রশংসিত হয় বিভিন্ন মহলে। কণ্ঠশিল্পী ইমরান অডিও, চলচ্চিত্র দুই মাধ্যমেই শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। ইমরান ‘নবাব এলএলবি’ ছবির ‘বিলিভ মি’ গানটি বেশ আলোচিত হয়েছে।
ভারতের জি বাংলা থেকে সারেগামাপার মাধ্যমে আসা নোবেলের গাওয়া দুটি গান ‘তামাশা’ ও ‘অভিনয়’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে ‘অভিনয়’ ইউটিউবে ৪২ লাখের বেশি শ্রোতা শুনেছেন। মাহদি সুলতান নামের নতুন এক গায়কের ‘মন বলে তুই শোন’ গানটির ভিউ দেড় কোটির বেশি। এতে মাহদির সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে আছেন প্রীতি শেখ। সালমার গাওয়া ‘রঙিলা বাড়ই’ মিউজিক ভিডিওটি ইউটিউবে শ্রোতারা শুনেছেন ১ কোটি ৩৬ লাখের বেশি। তানজীব সারোয়ারের গাওয়া ‘ডুবে ডুবে’ শুনেছেন ১ কোটির বেশি শ্রোতা।
আইয়ুব বচ্চুর গান সংরক্ষণ
চলতি বছরে সংগীতে আশা জাগানিয়া সংবাদ ছিল ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর ২ বছর পর গত আগস্টে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার ২৭২টি গান। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে রয়েছে এই শিল্পীর কনসার্ট ও দুর্লভ সব মুহূর্তের ভিডিও। এই প্রথম কোনো শিল্পীর নামে এমন উদ্যোগ নিলো সরকার।
নতুন গান ও মঞ্চে আর গাইবেন না ফেরদৌস ওয়াহিদ
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ আজকের পর থেকে আর কোনো নতুন গান করবেন না। মঞ্চেও গান করতে দেখা যাবে না তাকে। চলতি মাসেই তিনি তার এমন সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
গান বিতর্ক
‘আইপিডিসি আমাদের গান’ শিরোনামের আয়োজনে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের কণ্ঠে প্রকাশের পরই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ও প্রশংসিত হয়। গানটির কপিরাইট দাবি করা হয়েছে সরলপুর ব্যান্ডের পক্ষ থেকে। তবে এর মালিকানা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলমান।
সুরকার সাবিনা ইয়াসমিন
চিত্রনায়িকা কবরী পরিচালিত ছবিতে সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের আরেক কিংবদন্তী রুনা লায়লা এর আগে সুরকার হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ সবাইকে মুগ্ধ করেন। এর পরবর্তী সময়ে থেকে রুনা লায়লা নিয়মিত গানে সুর করে চলেছেন। একইভাবে এ বছর সাবিনা ইয়াসমিনের এই সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
যাদের হারিয়েছি
সুরকার ও সংগীত পরিচালক আজাদ রহমান ১৬ মে চলে যান না ফেরার দেশে। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’, ‘মনেরও রঙে রাঙাবো’, ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরকার, সংগীত-পরিচালক ছিলেন তিনি।
প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর মারা গেছেন ৬ জুলাই। ৮বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পীর কালজয়ী গানের তালিকায় রয়েছে-‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ ইত্যাদি।
বরেণ্য সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গীতিকার আলাউদ্দিন আলী মারা গেছেন ৯ আগস্ট। তিনিও ৮বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’ ও ‘যোগাযোগ’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার কর্ণধার সেলিম খান মারা গেছেন ১০ ডিসেম্বর। সংগীত পরিচালক সেলিম আশরাফ মারা গেছেন ২ মার্চ। তার সুরে উল্লেখযোগ্য দুটি গান হলো ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা’ ও ‘এই জাদুটা যদি সত্যি হয়ে যেত।’