আন্দোলনের সাথে সাথেই নেমে এলো ধ্বস! পোশাক প্রস্ততকারক রপ্তানিকারক শিল্প পুরোই হয়ে গেল স্থবির! ৫ আগস্ট পরবর্তী আন্দোলনকে ঘিরে বেশির ভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় গুমট পরিবেশ তৈরি হয়। মারামারি ধর পাকড় অগ্নি সংযোগ গোলাগোলি থেকে শুরু করে, নিরিহ পোশাক কর্মীর মৃত্যু- কি না ঘটল বিগত এই কয়েকটা মাসে! শ্রমিক অসন্তোষ। কারখানা শ্রমিকদের বেতন নিয়ে উসকে দেয়া। তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষনা। এগুলোর মানেটা কী? যে শ্রমিকরা ঘুম থেকে উঠে এতদিন গিয়েছে পেটের তাগিদে। এই শিল্পের উন্নয়ন আর নিজের পরিবারের একটু সুখ বুকে নিয়ে ফিরেছে বাড়িতে। সেই শ্রমিকরা-ই আবার নিজেরা নিজেদের কারখানাকে করেছে কলঙ্কিত! এর প্রভাবে ফায়দা লুটল কারা? বন্ধ হয়েছে একের পর এক তৈরি পোশাক কারখানা। ইট পাথরের আঘাতে কারখানার গ্লাস ভাঙল। অসহায় শ্রমিক মাথা ফেটে লাশ হলো! কারখানা বন্ধ হয়ে কত শত শ্রমিক বেকার হয়ে এখনও ঘুরছে পথে পথে! এ কোন অবস্থায় পড়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। পুরোই স্থবির একটা অবস্থা তৈরি হলো। আর এর প্রতিক্রিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ বাধাগ্রস্ত করে দিলো। ইতিমধ্যেই বিজিএমইএ সূত্রে বলা হয় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এই বিশাল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি। একটি দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গণে কতটা ভয়ের কারণ হতে পারে; সেটা এখন অনুমানের বিষয়? ৩শ থেকে ৪ শ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি এটা কি ভাবা যায়? একটা চালু শিল্পকে যারাই দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে পুরো একটি শিল্প ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। এই চক্রের শিকড় অমূলে বিণাশ করা জরুরি। দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ ঘটিয়ে কলকারখানা বন্ধ করলে যে আমাদের হাতের অর্ডার সব চলে যাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। সেটা এই শিল্পের সাথে জড়িতদের অবশ্যই বোঝা উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যারা কিনা তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের থেকেও পিছিয়ে ছিলো এতোদিন। তারা সবাই এখন এই শিল্পে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্রান্ডগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এটা তো এখন পরিস্কার- আওয়ামী তোষামোদী ব্যবসায়ীরা বেশি জড়িত এই শিল্পের সুনাম নষ্ট করার জন্য। যে কারণে অনেক মালিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পালিয়ে গেছে। অনেকে আছেন লাপাত্তা। এছাড়াও অনেকে পরিস্থিতি বুঝে আস্তে করে কারখানা গুটিয়ে কেটে পড়েছেন। ঝুঁকিতে পড়েছে শ্রমিক। ঝুঁকিতে পড়ে গেল শত শত কারখানা। হাজার হাজার শ্রমিকের বেতনের ঝুঁকির ও চাকরির ভয় দেখিয়ে উসকানি দাতারা শ্রমিকদের অহেতুক ক্ষেপিয়ে দেয়। ফলে কারখানাগুলোতে ঘটতে থাকে একের পর এক অনাচার। শ্রমিকরা না বুঝে মালিক মহাজনদের বিরুদ্ধে ক্ষেপেছে। বিগত আন্দোলনের দিকে তাকালেই বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়। শ্রমিকদের লেলিয়ে দেয় এক শ্রেণীর নেতা বনে যাওয়া ফরিয়া। যারা বিগত সরকার ও সরকারী তোষামুদে মালিক পক্ষের খাস লোক ছিল বলেই চিহ্নিত হয়েছে অনেকে। আন্দোলনের নামে পোশাক শিল্পের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করাই ছিল যাদের মূল লক্ষ্য। প্রত্যেকটি কারখানাকে এ জাতীয় দেশদ্রোহীকে খুঁজে বের করে পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। যারা বলছেন বিভিন্ন প্রতিকূলতার কথা। যে কারণে অনেকে এই শিল্প ধরে রাখতে পারছেন না। এসব ফালতু কথা। উদ্যোক্তাদের শিল্পজ্ঞান আশা করি অনেক ভাল। তা না হলে এই মালিক মহাজনরাই কিভাবে ১০ জানুয়ারি ২০২৪ সালে চীনকে হারিয়ে যুক্তরাজ্যে এই শিল্পে আমাদের শীর্ষে নিয়ে গেল? একই কারখানা, একই তো আমাদের শ্রমিক ভাই ও বোনরা দিন রাত কারখানায় কাজ করেছে। এরা বলছে, এখনও সবাই নিয়মিত কাজ করার জন্য প্রস্তত আছেন। কোথাও কোথাও তো কাজ রেন্ডম শুরুও হয়েছে। এখন যেটা প্রয়োজন – দেশপ্রেমী উদ্যোক্তা বা মালিক পক্ষ। যাদের হাত ধরেই আমরা গত বছর ভিয়েতনামের চেয়েও এগিয়ে ছিলাম। তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে আমরা চীন থেকে পিছিয়ে ২য় শীর্ষ স্থানে ছিলাম। আমরা ভিয়েতনাম থেকে ৭০০ কোটি ডলার বেশি মূল্যের তৈরি পোশাক বিশ্বে রপ্তানি করেছি গেল বছর। সাম্প্রতিক বেতন ভাতা ও অন্যান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে গাজিপুর, আশুলিয়াসহ দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার যে পায়তারা করা হয় বিক্ষোভ ও আন্দোলন ঘটিয়ে, এটাই এখন এই শিল্পের ভয়! যেই চীন ভিয়েতনাম ভারত এই শিল্পে আমাদের চির প্রতিদ্বন্দী ভাবে। এরাই এখন না চাইতে মেঘের মতই আমাদের অর্ডার সব লুফে নিচ্ছে। এই সুযোগ তো আমরাই তৈরি করে দিলাম। নিজেরাই নিজেদের স্যালাই মেশিনের চাকা বন্ধ করে! বিগত দুটি মাসের যে ধকল সহ্য করে এই শিল্প এখন পুনরায় চালু হয়েছে। এই স্পিরিট ধরে রাখতে হবে শুধু। অস্থির পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সাথে এটাও অন্তবর্তী সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। শ্রমিকদের বেতন যথাযথভাবে ধার্যকৃত নিয়মে বরাদ্দদানে দেখাতে হবে স্বচ্ছতা। যৌথবাহিনী দিয়ে কারখানাকে সুরক্ষিত রাখা যাবে। কিন্তু শ্রমিকের মানবিক বিষয়গুলো পূরণ তো পূরণ করা যাবে না? শ্রমের ন্যায্য মূল্যের কোন কমতি যেন না ঘটে এটা দেখতে হবে অর্থ উপদেষ্টাকে। যদিও বলা হয়েছে ৪০ লাখ শ্রমিক তাদের ন্যায্য মজুরি পাবে। সবকিছু নিয়েই এখন এগিয়ে নিতে হবে এই শিল্পকে। ২০২৫ সালে রপ্তানি আয়ে এই শিল্পের অবস্থান কি ঘটে, এটাই এখন দেখার বিষয়। যা আমাদের ২০২৫ সালের জন্য এই সরকারের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
ছবি : অনলাইন