২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ / ৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২২শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ৮:৫৭

শীতে বাড়ছে অ্যালোপেশিয়া রোগ

মারুফ আহমেদ

রোগের নামটা শুনে মানুষের ভয়ের কারণ নেই।
রোগটা কুকুর বিড়ালের। মানুষের ভয়ের চেয়ে এক্ষেত্রে পশুদের জন্য উদ্বেগটাই বেশি দেখা যায়। কেননা, অ্যালোপেশিয়া হলে কুকুর বিড়ালের শরীরের লোম পড়ে যায়। শরীরের জায়গায় জায়গায় লোমহীন এবড়ো থেবড়ো চামড়া দেখা যায় শুধু। রোগটা মারাত্মক। পথের কুকুরের জন্য তো আরও করুণ! রাস্তায় রাস্তায় এ ধরনের অনেক কুকুরই চোখে পড়ে। এই রোগ কুকুরের দেহের পশম সব কেড়ে নিয়ে, বেচারাকে সৌন্দর্যহীন করে দেয়! তবে পোষা কুকুরের ক্ষেত্রে ভিন্ন। ওরা উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পায়। যে কোন রোগের আগেই-পায় ওষুধ। সেবাযত্ন ও ভ্যাকসিন। সুস্থ জীবনে চলাফেরা করতে পারছে ঘর বাড়ির পালা বিড়াল। পালা কুকুর। কিন্তু বেগতিক জীবন শুধু পথের কুকুর বিড়ালের …
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যালোপেশিয়াকে বলা হয় সাইকল। যা একটা নির্দিষ্ট সময়ে পশুদের শরীরের পশম কেড়ে নেয়াকে বোঝায়। জীব-বৈচিত্র রক্ষায় পরিবেশের ভূমিকা তাই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের সাথেও এই রোগের আছে প্রবল সম্পর্ক । তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেও পশুর লোম পড়তে পারে। যা সারা বছর জুড়েই দেখা যায়। এর দায় শুধু প্রকৃতিকে দিলে হবে। যা সম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্ট। প্রকৃতির চেয়ে কঠিন এই রোগের দায় মানুষকেও নিতে হবে! আমরা যত্নবান হলে, প্রাণীরাও পাবে সুস্থ জীবনের নিরাপত্তা।
সবসময় রোগটিকে লোম হরণকারী বলা যাবে না। অন্য প্রাণীর চেয়ে কুকুরের ওপর রোগটি সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে। ফলে ওরাই বেশি অ্যালোপেশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। যে হারে শরীরের লোম পড়ে যায়, সেই হারে কি নতুন পশম গজায় শরীরে? গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে- এক ধরনের মেডিক্যাল ডিসঅর্ডারের কারণেই মূলতঃ কুকুরের লোম পড়ে যায়। নতুন লোম না ওঠার পেছনেও আছে লোম না ওঠার ব্যর্থতা। যা একধরণের হাইপারথাইরয়েডিজম। এই সমস্যায় আক্রান্ত পশুটির শরীরে- প্যারাসাইট, ফাঙ্গাস ও কিছু ব্যাকটেরিয়াল ত্বকের সংক্রমণ লক্ষ করা হয়। এখানে হরমোনের জিনগত বিষয়টি জড়িত। যে সব হরমোন লোম তৈরি নিয়ন্ত্রণ করে তা সূর্যের আলো এবং তাপমাত্রা দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে; ‘‘ যে সব কুকুরের রক্ত সঞ্চালন ভাল, তাদের লোম সহজে গজায়। কিন্তু ঠিকমত রক্ত সঞ্চালন না থাকায় নতুন লোম ঠিকঠাক গজায় না।” পরিবেশের অন্য কীট পতঙ্গও কুকুরের এই রোগের জন্য হুমকী। কেননা বাইরের প্যারাসাইট হচ্ছে অ্যালোপেশিয়ার অন্যতম কারণ। মশা, মাছি, বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র পোকা, উকুন ইত্যাদি ক্ষতিকারক রক্তচোষা ক্ষুদ্র পতঙ্গ খুব সহজে কুকুর বিড়ালের শরীরে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এদের উপস্থিতি চব্বিশ ঘন্টা পশুর শরীরে এক ধরণের চুলকানি সৃষ্টি করে। কুকুর বিড়াল লেজ দিয়ে, মুখ দিয়ে চুলকোয়। এতটা বিরক্তকর বিষয় এটা। পথের ধারের যে কোন কুকুরের শরীরে একটা ছোট্ট মাছি বসলে দেখবেন, কি পরিমাণ বিরক্ত হয়ে ওরা- মশা-মাছি তাড়াচ্ছে। কুকুর, ভেড়া, ছাগল, মহিষ ও অন্যান্য সব প্রাণীকেও এমন ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গের সাথে লড়তে হয়। ওরা যতই শরীর চুলকোয়। ততই লোমশ শরীর থেকে পশম ঝড়তে থাকে। এক সময় ত্বকে ফাঙ্গাস ইনফেকশন হয়ে ডার্মাটোফাইটিস ঘটায়। এভাবেই ধীরে ধীরে কুকুরের শরীরে কখনও আংশিক কিংবা কখনও সম্পূর্ণ অ্যালোপেশিয়া সংক্রমণ ঘটে। তবে ব্যাকটেরিয়াল ফলিকিউলাইটিসের কারণে মাল্টিফোকাল অ্যালোপেশিয়া হলে কুকুরের শরীরে গোল আকারে নির্দিষ্ট একটা স্থানের লোম উঠে থাকে। আর গুচ্ছ অ্যালোপেশিয়া হয় অ্যালার্জিক কারণে। এই সময় কুকুর অথবা বিড়াল দেখবেন- দাঁত দিয়ে শরীরের কোন স্থানে কামড়ে নিজের শরীর চুলকিয়ে একটু আরাম বোধ করছে। কামড়াতে কামড়াতে শরীরের বিপুল পরিমাণ পশম কিন্তু সে নিজেই তুলে ফেলছে!
ভ্যাটেরিনারী সায়েন্সে পশুদের অ্যালার্জীর বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। বিশেষ করে কুকুরের জন্য। মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত খাবার থেকেও হতে পারে কঠিন অ্যালার্জী। সিগারেটের ধোঁয়া ও পারফিউমও কখনও ওদের খুব কষ্টের কারণ হয়। সিগারেট ও পারফিউমের কটু গন্ধ কুকুর বিড়ালের নিশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে প্রবেশ করে। বাড়ির মোলায়েম কার্পেটও এলার্জিমুক্ত নয়। কার্পেটের ধুলো এমনকি ঘরের ধুলোবালি থেকেও পশুপাখির অ্যালার্জী হতে পারে।
কুকুর বিড়ালের লোম রক্ষায় আছে এর সুন্দর সমাধান। সেটা খাবারের মাধ্যমেই প্রয়োগ করতে হয়। অ্যালোপেশিয়া রোগ থেকে সুস্থ থাকতে খাবারের তালিকায় নিউট্রিয়েন্স বা পুষ্টিগুণের কথা বলছে সবার আগে। আগে খাবার। পরে ওষুধ। প্রিয় কুকুর বিড়ালের ভাল রক্ত সঞ্চালনে ভিটামিন, মিরারেলস, অ্যান্টি অক্সিড্যান্টস, ওমেগা-৩, ওমেগা-৬, ফ্যাটি অ্যাসিড প্রয়োজন। ওদের শরীর থেকে যখন অল্প লোম পড়ে, সেটা চোখে পড়ে না। কিন্তু অস্বাভাবিক মাত্রায় শরীর থেকে লোম ঝড়লে অথবা পিঠের চামড়া বেরিয়ে গেলে-ই আমরা কারণ খুঁজতে থাকি। তবে শীত কালেই এর প্রকোপটা বেশি ঘটে। এই মৌসুমে ওদের শরীরের চামড়া অন্যান্য ঋতুর চেয়ে আরও বেশি শুষ্ক হয়। আমরা তখন ওদের গোসলের চেষ্টা করি। আর এখানেও ভুল করি বারবার। যেই সাবান ও শ্যাম্পু ওদের মাখি। দেখতে হবে অ্যালার্জীমুক্ত কিনা? কুকুর বা বিড়াল গন্ধটা গ্রহণে অস্বিকৃতি জ্ঞাপন করলেই- বুঝতে হবে, পরিচ্ছন্নতার চেয়ে এটা ওদের ত্বকের ক্ষতি করছে বেশি। ওদের বাসস্থানেরও বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। পথের বিড়াল-কুকুরের প্রতিও মানবিক মনের মানুষদের সহানুভূতি দেখানো উচিত। ভেজা স্যাতস্যাতে জায়গা থেকে ওদের রক্ষা করতে হবে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান অয়েনন্টমেন্ট ক্রীম অথবা নিউমেক ওষুধের কথা বলে থাকেন। পশু-চিকিৎসকের পরামর্র্শ ছাড়া ভুলেও কেউ কুকুর বিড়ালের ট্রিটমেন্টে যাবেন না। কেননা-উপকারের চেয়ে সেটা ক্ষতির কারণ হতে পারে বেশি। যা নিরিহ পশুপাখির জন্য ঘটবে হিতে-বিপরীত। একটি আমেরিকান গবেষণায় উঠে এসেছে: “জীবজন্তুর ওষুধে অনেক সময় পশুদের মধ্যে পরজীবি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ‘আইভারমেকটিন’ ব্যবহার করা হয়, তা ১০ মিলিগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলে জীবজন্তু ও গৃহপালিত পশুপ্রাণীর জন্য ভাল। কিন্তু নির্দিষ্ট ব্যবহারবিধির বাইরে চিকিৎসাসেবায়- পেট খারাপ,বমি, ডায়রিয়া,হৃদস্পন্দনে অস্থিরতা,পাগলামি, চোখের সমস্যার মতো মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কখনও প্রাণীটি মারাও যেতে পারে। আমরা জানি; এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করে ২০১৫ সালে আইরিশ বংশোদ্ভূত উইলিয়াম ক্যাম্পবেল এবং জাপানের সাতোশি ওমুরা মেডিসিনে নোবেল পদক পেয়েছেন।
ধরুণ, ‘আইভারমেকটিনে’ নিষেধাজ্ঞা আছে, ৬ বছরের কম বয়সী কুকুর বিড়ালকে দেয়া যাবে না। লোম ও পশম পড়ে যাচ্ছে দেখে ইন্টারনেট সার্চ দিয়ে অনেকে ‘আইভারমেকটিন’ ভরপুর কোন ওষুধ যদি ৬ বছরের কম বয়সের কুকুরকে খেতে দেয়, ফলাফল কি ঘটতে পারে, পাঠক, বুঝে নিন। নিজে নিজে ডাক্তারিতে নিরিহ পশুদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট কেন? আমরা সেবা করব ঠিক আছে। তবে নিয়ম মেনে। পশুচিকিৎসকের সহায়তায়। প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে ভেষজ ওষুধে পশু পাখির ক্ষতির তেমন সম্ভাবনা নেই। প্রয়োজনে ক্ষত স্থানে প্রাথমিক চিকিৎসায় হলুদবাটা মেখে দিতে পারি। অথবা অ্যালোপেশিয়া সংক্রমণে যেখানে লোম পড়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই জায়গাটুকুতে অলিভওয়েল অথবা আপেল সিডার ভিনেগার সম-পানির সাথে মিশিয়ে তুলোতে ভিজিয়ে লাগিয়ে দিতে পারি। তবে প্রাণীর চোখ সাবধান। ভিনেগার পানি চোখে দেয়া যাবে না। শুকালে ঐ ক্ষতস্থান কিছুক্ষণ পরে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। এভাবে ঘরোয়া উপায়েও বিড়াল কুকুরের অ্যালোপেশিয়া সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।

অনলাইনের বিভিন্ন কোম্পানীর চটকদার বিজ্ঞাপনে মজে গিয়ে, না বুঝে, পশুপাখির ওষুধ সংগ্রহ করবেন না।

মনে রাখবেন:

কোম্পানীর ওষুধের প্রচারণার চেয়ে নিরিহ জীবজন্তুর জীবনের মূল্য অনেক বেশি …

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি

Facebook
Twitter
LinkedIn