ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশে আসতে পারে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিন। এমনই ইঙ্গিত দিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল বাশার মুহাম্মদ খুরশীদ আলম। এ উদ্দেশ্যে আজ রোববার বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকার ৬০০ কোটি টাকা জমা দেবে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। ভারত ইতোমধ্যে সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ফলে ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে আসতে আর কোনো বাধা নেই। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে চুক্তি করে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কেনার জন্য। চুক্তি অনুযায়ী সিরাম ইনস্টিটিউট আগামী জুনের মধ্যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেবে বাংলাদেশকে। এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসবে। এই শর্তে জুনের মধ্যে সিরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন না দিতে পারলে টাকা ফেরত দেবে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে খুব সহজেই সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই ভ্যাকসিনটি সাধারণ রেফ্রিজারেটরে (ফ্রিজার) ৪ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে কিভাবে ভ্যাকসিন আনা হবে এর পুরো পরিকল্পনা তারা করে রেখেছে। ভ্যাকসিনের ডোজগুলো প্রথমে টঙ্গীতে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষণ করা হবে। পরে সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন কোল্ডস্টোরেজে তাদের ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে দেয়া হবে। পরে সেখান থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্যবস্থাপনায় ভ্যাকসিনগুলো নেয়া হবে বিভিন্ন টিকাদান কেন্দ্রে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক জানান, অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স নামক ভ্যাকসিনটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। শিম্পাঞ্জির দেহে সর্দি-জ্বর সৃষ্টিকারী একটি ভাইরাসকে ল্যাবরেটরিতে দুর্বল করে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ফ্লু ভাইরাস, জিকা ভাইরাস ও মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক তৈরি করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায় শিম্পাঞ্জির এই ভাইরাসটি ব্যবহার করে। শিম্পাঞ্জির সর্দির জন্য দায়ী এই ভাইরাসটিতে গবেষণাগারে করোনাভাইরাসের মতো কৃত্রিম স্পাইক প্রোটিন সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। জিন সম্পাদিত এই ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করালে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের এই কৃত্রিম স্পাইককে হুমকি হিসেবে দেখে থাকে এবং তা ধ্বংস করার চেষ্টা করে। জিন এডিটেড ভাইরাসের স্পাইক মানুষকে কোনো ক্ষতি করতে পারে না; কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করতে শিখে যায় এবং এই ধ্বংস করার প্রক্রিয়াটি কোষের মেমোরিতে থেকে যায়। পরে যখন প্রকৃত করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শরীরে প্রবেশ করে তখন শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) স্পাইকটিকে শনাক্ত করে এবং আগের ধ্বংস করার ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোভিড-১৯ ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে দেয়।
অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, শিম্পাঞ্জির ওই ভাইরাসটিকে গবেষণাগারে এমনভাবে পাল্টে দেয়া হয়েছে যেন এই ভাইরাসটি শরীরে আর বংশ বৃদ্ধি করে বেড়ে উঠতে না পারে। করোনাভাইরাসের যে রূপান্তরিত স্ট্রেইন পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার চ্যাডক্স ভ্যাকসিন তাও ধ্বংস করতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম ফোনে জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিনটি নিলে সিভিয়ার (তীব্র) কোভিডে আক্রান্ত হয় না কেউ। অথবা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে কাউকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয় না। এই শক্তিটিই অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির মূল ভরসা। এর কার্যকারিতা ৬০ শতাংশ নাকি ৯০ শতাংশ এটা নিয়ে ভেবে তেমন লাভ নেই। ভারতে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো খবর। তিনি বলেন, পাঁচ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে সিরাম ইনস্টিটিউট প্রস্তুত করে রেখেছে। তিনি বলেন, এখনই বাংলাদেশের উচিত ভ্যাকসিনেশনের একটা মক ট্রায়াল (নকল প্রয়োগ) করা; যাতে করে প্রকৃত ভ্যাকসিন প্রদানের সময় সব কিছু পরিকল্পনামাফিক হয়। প্ল্যানিং এবং ইমপ্লিমেন্টেশনের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হলে একটা মক ট্রায়াল জরুরি।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটিসহ আরো দুইটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে ফাইজার ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আরেকটি ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মডার্না তৈরি করেছে। বাংলাদেশের জন্য অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন সবচেয়ে উপযোগী। কারণ এটা সংরক্ষণ করা যাবে সহজেই। ফাইজারের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা দেশে নেই। এই ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।