মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
শুরু হয়ে গেছে সয়াবিন তেলের সিন্ডিকেট। দুর্নিতীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে যেই চক্র। দুর্গাপুজা, মাহে রমজান, ঈদসহ বিশেষ সময় আসলেই এই চক্রটি সক্রিয় হয়। গোপনে নিত্য পণ্য বাজার থেকে হাওয়া করে দেয়! এরা সবাই কর্পোরেট নামধারী বড় বড় মার্চেন্ট বা তেল আমদানীকারক!
বাজার মনিটরিং করে দেখা গেছে, বিগত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্য পণ্য সয়াবিন তেল ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় দোকানে সয়াবিন তেল কিনতে গেলেই বিক্রেতা বলছে তেল নাই! তেল নাই নাই করে পরপর দুটি সপ্তাহ শেষ। গতকাল রাত পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশে। কিছু অসাধু বিক্রেতা আগে মজুদ করে রাখা নামী দামী বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করছে চড়া দামে! অথচ কোম্পানী থেকে তারা কিন্তু আগের কম মূল্যেই তেল ক্রয় করেছে। এই সুযোগ হাত ছাড়া করছে না খোলা বাজারের খোলা সয়াবিন তেলের ডিলারেরাও। এই শ্রেণীর তেল ব্যবসায়ীরা লিটার প্রতি বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আর খোলা তেলের কারসাজি হচ্ছে ১ নং তেল ও ২ নং তেলের ভেতর। ১ নং তেল পাওয়াই দুসাধ্য! কথাটি জানালেন দক্ষিণ সিটির ৪ নং ওয়ার্ডের গৃহিনী সালেহা বেগম। তিনি ২ নং তেল কিনেছেন গতকাল ১৯০ টাকা লিটার। তিনি আরও জানালেন- দুই সপ্তাহ আগে তিনি খোলা তেল কিনেছেন ১ নং তেল ২০০ টাকায়। এখন লুকিয়ে ১ নং তেল বিক্রেতারা নিজস্ব পরিচিতদের শুধু দিচ্ছেন ২২০ টাকা লিটারে। মাদারটেক নিবাসী ইব্রাহিম সাহেব যেই মুদি দোকান থেকে সদাই নেন, সেই দোকানে ৫ দিন ঘুরেও তিনি বোতলজাত তেল সংগ্রহ করতে পারেননি। রান্নার প্রয়োজনীয় বলেই বাধ্য হয়ে বাজারের পরিচিত এক দোকান থেকে আপাতত মাত্র ১ লিটারের বোতলজাত তেল কিনেছেন। দাম ছিল ১৭০ টাকা। তিনি বলেন; ছোট বোতলে লস হয় আর ৫ লিটার ২০-২৫ অনেকে ১ মাসও ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে ৫ লিটার ৮২০-৮৩০ টাকায়ও কিনেছি। এখন তো দোকানেই পাচ্ছি না। ’
মহল্লা ও বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীরা খোলা তেল ও ছোট তেলের বোতল ইতিমধ্যেই বিক্রি করে ফেলছে। ৫ লিটারের (রূপচাঁদা) এর তেল নিয়ে সবুজবাগ থানার অধিবাসী সফিক আহমেদ জানালেন একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা-‘ আমি গতকাল (শুক্রবার রাতে) ৩০ মিনিট পথ হেঁটে একটা দোকানেও ৫ লিটার তেলের বোতল কিনতে পারিনি। আর কোথাও পেলেও আকাশ পাতাল দাম চাওয়ায় কেনা সম্ভব হয়নি। তবে এই শীতেও ঘেমে নেয়ে অবশেষে মাদারটেক মাছ বাজারের সন্নিকটে এক দোকানে ৫ লিটারর তেল কিনতে যাই। দোকানদার বলল ৮৬০ টাকা! অথচ বিশ্বাস করবেন না- এই তেলই আমারই এক বন্ধু গত পরশু কিনেছে ৮৫০ টাকায়! কেউ ৮৫২ টাকাও রাখে। আজ চাচ্ছে ৮৬০ টাকা? কিন্তু অসাধু দোকানদার আমাকে শর্ত জুড়ে দেয়- সেই একই কোম্পানীর পোলাওয়ের চাল কিনলে আমার কাছে সে তেল বিক্রি করবে! কি একটা নাকাল অবস্থায় আছি আমরা দেখুন?’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে দোকানীরা জানায় এই প্রক্রিয়ায় তেল বিক্রির অফার নাকি কোম্পানী থেকেই দেয়া হয়েছে। তারাও এভাবেই কোম্পানী থেকে তেলের সাথে নাকি পোলাওয়ের চাল ক্রয় করেছে! ভুক্তভোগীরা জানায় সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী তেল কিনে রান্না করতেই হিমশিম খাচ্ছে, পোলাও খাওয়ার বিলাসীতা দেশের মানুষ দেখাবে কোন সাহসে?
নামীদামী কোম্পানীগুলোর কারসাজিতে প্রতি লিটারে লিটারে ১০ থেকে ২০ টাকা ভর্তুকী দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশে তেল আমদানি হয় ২৩ লাখ টন তেল! আর চলতি বছর পর্যন্ত সয়াবিন ও পাম ওয়েল আমদানির পরিমাণ ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন থেকে ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। সূত্রমতে এই হিসেবে সয়াবিন ও পাম তেলের যে পরিমাণ মজুদ থাকার কথা। তাহলে বাজারে কেন তেল নেই। এই কারসাজি বুঝতে দেশের মানুষের কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কে প্রশ্ন করার মনে হয় না প্রয়োজন আছে?
এখন থেকেই কঠোর হাতে সিন্ডিকেড বাহিনীর গোপন গুদামের ভোজ্য সয়াবিন তেল খুঁজে বের করতে না পারলে রোজার সময় তেল নিয়ে আরও কঠিন সংকট দেখা দিবে। আর সিন্ডিকেড বাহিনীর যদি তেল আমদানী নিয়ে কোন অভিলাষ থাকে সেটাও তো বাণিজ্যনীতি অনুসরণে করা উচিত। সাধারণ মানুষের সাথে এত জটিল কঠিন নাটকের তো প্রয়োজন নেই?
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গেল ডিসেম্বর মাসে ভোজ্যতেলের বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বললেও জানুয়ারি শেষ হওয়ার পরও কেন বাজারে এখনও সয়াবিন ও পাম অয়েল সংকট চলছে। আসন্ন মাহে রমজানের আগেই এর সুরাহায় আসতে না পারলে এই অধিদপ্তরের মুখস্ত বুলি-‘ যে কোন অনিয়ম সামনে এলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’ র প্রতি দেশজনতা আর বিশ্বাস রাখবে না। রুখতে হবে সিন্ডিকেট বাহিনীর অসাধু চক্রান্ত। গত বছরের মার্চে ভোক্তা অধিকার যেভাবে সব নামীদামী তেল কোম্পানীর কারখানায় হানা দিয়েছে ‘অসাধু পন্থা’ রুখে দিতে, এবার ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কি দায়িত্ব পালন করে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় জাতি …