কামরুল ইসলাম সাতক্ষীরা প্রতিনিধি :নানান রঙয়ের নানান স্বাদের মিষ্টি তৈরি করেন ময়রারা। যা খেতে খুব সুস্বাদু। কাঁচের ঘরে সাজিয়ে রাখা রং বেরঙের মিষ্টি। যে কারও খেতে ইচ্ছে করে। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নানাভাবে অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয় এই সব নানান স্বাদের মিষ্টি। কিন্ত বাহারি স্বাদের মিষ্টিগুলো যেভাবে তৈরি করা হয় তা দেখলে মুহূর্তের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে সে ইচ্ছে। যে কেউ বলবেন, আমরা কি খাচ্ছি, মিষ্টি না অখাদ্য?অভিজাত ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোকান চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন। তাকে থরে থরে সাজানো থাকে এই মিষ্টি। দামও অনেক বেশি। যারা পয়সাওয়ালা তারাই এর ক্রেতা। দৃষ্টি নন্দন প্যাকেটে ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডারের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি যাচ্ছে শহর ছেড়ে গ্রামেও। তবে এর কারখানার দৃশ্যপট অন্যরকম। সাতক্ষীরা শহর ছেড়ে অনেক দূরে তাদের কারখানা। পাটকেলঘাটা বলফিল্ড সংলগ্ন খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে এর অবস্থান।
অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে কারখানায় তৈরি হচ্ছে রঙ-বাহারি মিষ্টি। স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘর। ঘরে ময়লা আবর্জনা। পোকামাকড়ে ভরপুর। ঘরের মেঝেয় ময়লা পানি, রীতিমতো কাদায় ভরপুর। বলবেন, ঘরের ভেতরে কি সারাবছর বর্ষার পানি পড়ে!
মিষ্টি তৈরির যারা কারিগর সেই ময়রারা ময়লা হাতে তৈরি করছে মিষ্টি। মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে সিরা। সিরা ভরা কড়াইতে উড়ে পড়ছে মাছি ও ভাসছে পিঁপড়া। মিষ্টি রাখার পাত্র আর আসবাবপত্রগুলো বিবর্ণ। ময়লা আর ঝুলকালিতে ভরা। কতোদিন পরিষ্কার করা হয়নি তা খোদ ভাগ্যকুল কর্র্তৃপক্ষও বলতে পারবেন না। তৈরি করা মিষ্টি রাখা হচ্ছে নোংরা কাপড়ের ওপর। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মেঝের ওপর ছড়ানো-ছিটানো ময়লার স্তুপ। চিনি ও ময়দার বস্তায় পোকামাকড়ের বসবাস। মাছির ভনভনানি। বিশাল মাটির চুলার ওপরে বসানো কড়াই। কড়াইয়ে দুধ জ্বালিয়ে বানানো হচ্ছে ক্ষীর। নিচে কাঠ জ্বালানো চুলার ধোঁয়ায় মেশা ছাই উড়ে পড়ছে মিষ্টির কড়াইগুলোতে।
কারখানার ভেতরে তেলাপোকা আর ইঁদুরের রাজত্ব। বড় বড় পাত্রে রাখা হয় মিষ্টি। বড় পাতিলে থরে থরে সাজানো মিষ্টি। তার ওপর তেলাপোকার দাপাদাপি। রসগোল্লার পাত্রে তেলাপোকা-ইঁদুরের উৎপাত। কারখানায় তৈরি মিষ্টিগুলো রাখা হয় খোলা অবস্থায়। তাতে জমছে রাস্তার উড়ে আসা ধুলাবালি। এতে বাড়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি।
নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ গুড়ো দুধ, আটা-ময়দা মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ছানা। এই ছানার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর সোডিয়াম, সাইক্লামেট বা ঘনচিনি। ঘন চিনিতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট মূলত এক ধরনের রাসায়নিক সার। দুধের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে পাউডার। সিনথিটিক রং মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানা রকমের মিষ্টি। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি মিষ্টিই সাজানো হয় ভাগ্যকুলের বিপনী কেন্দ্রগুলোতে।
কারখানার একজন শ্রমিক বললেন, মিষ্টি তৈরির জন্য ময়দা, চিনি ও ছানা মেশানোর সময় তাতে খাওয়ার সোডা মেশানো হয়। এতে মিষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফুলে যায়। অনেক সময় মিষ্টি টেকসই করতে ব্যবহার করা হয় সালটু হাইড্রোয়েট ও ব্যাকিং পাউডার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন শিক্ষক বলেন, ভাগ্যকুল মিষ্টির কারখানায় তৈরি ভেজাল মিষ্টি কিনে একদিকে ক্রেতারা ঠকছে, অন্যদিকে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা খুব বেশি। তাদের আর দোষ কী। এমন কোনও মিষ্টির কারখানা বা দোকান নেই যেখানে ভেজাল নেই।
শুধু নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই যে মিষ্টি তৈরি হয় তা নয়, মিষ্টিতে মেশানো হচ্ছে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। এ ধরনের মিষ্টি খেলে জনসাধারণের ডায়রিয়া, আমাশয়, লিভার নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অনেক সময় তাৎক্ষণিক ক্ষতি না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এই ভেজাল মিষ্টি খাওয়ায় একসময় জটিল রোগব্যাধি সহ ক্যান্সারও হতে পারে।
কোনও প্রতিকার নেই, প্রতিরোধ অভিযান যে হচ্ছে না, তাও নয়। এই ধরনের অপরাধের কারণে ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডারকে বারকয়েক জরিমানা দিতে হয়েছে। তাতে কোনও সফলতা আসেনি। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা দিলেও বন্ধ হয়নি তাদের এই অনৈতিক কারবার। বরং বেড়ে আরও দ্বিগুন হয়েছে।