২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ১১:২৮
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ১১:২৮

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে

বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করা করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সমপ্রতি ভারতফেরত কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের ওই ভারতীয় ধরনটি শনাক্ত করেছে। ঢাকা ও যশোরের পৃথক ল্যাবে একই নমুনা পরীক্ষা করে এই ধরনটি শনাক্ত হয়। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। মিউটেশনের কারণে এর তিনটি ‘সাব-টাইপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া গেছে বি.১.৬১৭.২ ধরনটি। ভারতে প্রথম এ মিউট্যান্ট শনাক্ত হয়েছিল বলে একে ভারতীয় ধরন বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই ডজন দেশে করোনাভাইরাসের এ ধরনটি পৌঁছে গেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।

যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ভাইরাসের ভারতীয় তিনটি ধরনের মধ্যে বি.১.৬১৭.২ ধরনটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সমপ্রতি বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারতফেরত কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়। তার মধ্যে দুটি নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। চারটি নমুনা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রায় কাছাকাছি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের পরীক্ষায় একই ফল পেয়েছে জানিয়ে নাসিমা সুলতানা বলেন, এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই মানুষকে খুবই বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ৬ই মে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল থেকে ভারতফেরত ১৬ জনের নমুনা পাঠানো হয়। নমুনা পরীক্ষা করে তাদের ৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়।

অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক মো. ইকবাল কবীর জাহিদের নেতৃত্বে গবেষকরা জেনেটিক সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করেন। তাতে দুজনের শরীরে পাওয়া করোনাভাইরাস যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।

আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ: করোনার ভারতীয় ধরনটি দেশে আসায় যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। যাতে খারাপ কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, ভারতীয় ধরন নিয়ে আমাদের আর বিশেষভাবে কিছু করার নেই। আমরা যেভাবে অন্য ধরন থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেছি সেভাবে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যেটা আমরা মানছি না।

কিন্তু ভাইরাস যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমরা তো কথাই শুনছি না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা না মেনে দোকানে কেনাকাটা করছি। মাস্ক পরছি না। এ বিষয়ে কি করা উচিত সেটা আমরা গত বছরই বলেছি। হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা এবং অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানো উচিত। অক্সিজেন নিয়ে তো আমরা কিছুই করছি না। অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে কিনা, কতোটা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট নেই। সবাই চুপচাপ বসে আছে। এখন হাসপাতালগুলোতে অনেক বেড তৈরি করলেও আমরা জায়গা দিতে পারবো না, এসব বললেই আমাদের হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় বহু সংখ্যক মানুষ মারা যাবে। কারণ, আমাদের পর্যাপ্ত হাসপাতাল ব্যবস্থা নেই। একটি মাত্র কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করে আত্মতুষ্টিতে ভুগে বেফাঁস কথা বলে ফেলি। আমাদের সরকারকে বলতে হবে, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা এবং আরো হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, আমার মতটা একটু ভিন্ন, সাধারণ মতের চেয়ে। সেটা হলো- ভারতের ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন যেটা পাওয়া গেছে সেটা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। এ বিষয়ে যে সকল গবেষণা হয়েছে সে গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ভ্যারিয়েন্ট অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ক্ষতিকারক। এটা খুব অল্প সময়ে মানুষের খুব মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করে। এখন আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভ্যারিয়েন্টের প্রতি অতোটা সিরিয়াস না হয়ে আমাদের দেশে যে কমন ভ্যারিয়েন্ট আছে সেটা মোবাবিলা করা দরকার। আর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে আমাদের আরো বিস্তর গবেষণা করা দরকার। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট এসেছে প্রতিটি ভ্যারিয়েন্টেই কোনো না কোনো টিকায় সেটা প্রতিরোধ করা গেছে। সুতারং ভেরিয়েন্টের উপরে অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২৫ কোটি ডোজ টিকা এনে মানুষকে দেয়া। এটার উপরে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি গবেষণা চলতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ভারতীয় আর ইউকে ভ্যারিয়েন্ট যেটাই হোক না কেন এগুলো নিয়ে চিন্তা না করে কমন ভেরিয়েন্ট যেটাতে বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে সেই ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে আমাদেরকে লড়াই করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের কাজ হবে দু’টি। প্রথমত- সচেতনতা বৃদ্ধি, মানুষজনকে সম্পৃক্ত করা। দ্বিতীয়ত- স্বাস্থ্যবিধি মানা। এবং সর্বশেষ যেটি হলো- আমাদের যতদ্রুত সম্ভব ২৫ কোটি ডোজ টিকা আমদানি করে সাধারণ মানুষকে দেয়া। এটার মাধ্যমে আমরা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারবো। সর্বশেষ হলো ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা করা। প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে প্রফেসর মোজাহেরুল বলেন, আমাদেরকে সবচেয়ে আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পেলেক্সগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে। এবং সেখানে আইসোলেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো করার ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেন, অক্সিজেন মাস্ক, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এই তিনটি জিনিস উপজেলা হেল্‌থ কম্পপ্লেক্সে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সেখানে আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn