কোভিডে মৃত মায়ের লাশ নিয়ে কীভাবে কত দ্রুত দেশে ফিরবেন, মর্যাদার সাথে মাকে দাফন করতে পারবেন তা নিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন নাহিদ নাসের তৃণা, তার দুই বোন, চাচাতো ভাই এবং শোকে কাতর বাবা।
দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে অনাপত্তিপত্রের (এনওসি) জন্য আবেদন করেছেন তারা, কিন্তু রোববার বিকেল পর্যন্ত তা তাদের কাছে আসেনি। শুধু মায়ের লাশের ছাড়পত্র হাতে পাওয়া গেছে। মৃত মা শুক্রবার থেকেই হাসপাতালের হিমঘরে।
‘আমাদের মনের অবস্থা যে এখন কেমন তা বলে বোঝাতে পারবো না,’ দিল্লি থেকে টেলিফোনে বিবিসিকে বলছিলেন ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তৃণা।
ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা
এমনিতে গুলশান আক্তারের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার স্বামী এবং সন্তানেরা। কিন্তু শোকের চাইতে লাশ নিয়ে দেশে ফেরা এবং তার দাফন নিয়ে শোকের চেয়ে উদ্বেগই বেশি ভর করেছে পুরো পরিবারের ওপর।
‘কখন দেশে যাওয়া যাবে? বিমান নেই, ফলে কিভাবে এতদূর মায়ের লাশ নিয়ে যাবো? বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে যদি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় কীভাবে তা সম্ভব হবে? মায়ের দাফন কোথায় কীভাবে হবে, এসব চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে আছে সবার,’ বলেন তিনি।
শুধু গুলশান আক্তারই নয়, সাতজনের পরিবারের সবাই একে একে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। উপসর্গ চলে গেলেও সবাই যে নেগেটিভ হয়েছেন রোববার পর্যন্ত সেই টেস্টের ফলাফল তারা পাননি।
নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি বদলানোর জন্য গত ২৬ মার্চ দিল্লিতে যান গুলশান আক্তার। সাথে ছিলেন স্বামী, তিন মেয়ে এবং তাদের চাচাতো ভাই এবং বাসার গৃহকর্মী। দিল্লির উপকণ্ঠে ফিরোজাবাদ এলাকায় হাসপাতালের কাছে একটি বাসা ভাড়া নেন তারা।
দিল্লির কোভিড পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করেছে।
‘মায়ের ডায়ালাইসিস চলছিল, সপ্তাহে তিন দিন। শহরের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কটের খবর শুনছিলাম। চিন্তা ঢুকেছিল মায়ের চিকিৎসা এখন ঠিকমত কি হবে?’, বলেন তৃণা।
পরিবারের সবার কোভিড
আশঙ্কা সত্যি রূপ নিল যখন ২১ এপ্রিল তৃণার বাবা এবং দুই বোনের কোভিড ধরা পড়লো। দুদিন পর ধরা পড়লো তার মায়ের। তার পর একে একে সবার।
গুলশান আক্তারের শরীরে অক্সিজেন দ্রুত কমতে থাকায় ২৬ এপ্রিল তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিন-চার দিনের মাথায় তিনি অচেতন হয়ে পড়লে আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেটরে নেয়া হয়। তারপর শুক্রবার ডাক্তাররা জানান হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন।
‘আমরা মনে করিনা চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি হয়েছে, কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পর মা প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েছিলেন। তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়। হিন্দি বা ইংরেজি বলতে পারতেন না। আমাদের সাথেও দেখা হতো না। আমার মনে হয় ওই চাপ তিনি নিতে পারেননি।’
গুলশান আরা মাঝে মধ্যে পরিবারকে বলতেন মৃত্যুর পর তাকে যেন নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। ‘আমরা কি তা পারবো জানিনা,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তৃণা।
এনওসি পেলেও ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের আসতে হচ্ছে বেনাপোল স্থল সীমান্ত দিয়ে। ঢোকার পর সেখানে তাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। সেই চিন্তাতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তৃণা, তার ভাই-বোন এবং বাবা।
আটকা পড়েছেন অনেকে
তৃণার পরিবারের মতো কম-বেশি একই সঙ্কটে পড়েছেন ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বহু বাংলাদেশী।
চেন্নাইতে চিকিৎসা করতে গিয়ে একইভাবে আটকা পড়েছেন মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং তার স্ত্রী। বললেন তার শরীরের যে অবস্থা তাতে স্থলপথে ফেরা সম্ভব নয়, ফলে এনওসির জন্য আবেদনও করেননি।
বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ঢোকার পর সেখানে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকা নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে না ফিরে চেন্নাই থেকে দুবাইতে গিয়ে সেখানে কিছু দিন থাকার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ভারত থেকে দুবাইয়ের ফ্লাইটও বন্ধ।
‘হোটেলে খাঁচাবদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছি,’ চেন্নাই থেকে টেলিফোনে তিনি বিবিসিকে বলেন।
কামরুজ্জামান জানান, যে হাসপাতালে তার চিকিৎসা হচ্ছিল সেখানেই শনিবার বাংলাদেশী একজন ক্যানসারের রোগী মারা গেছেন।
‘লাশ দেশে নিয়ে যাওয়া নিয়ে সাথে আসা পরিবারের সদস্য চোখে অন্ধকার দেখছেন। সরকারের উচিৎ শিগগির বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে এমন সঙ্কটে পড়া লোকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।’
জানা গেছে, কোভিডের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বেড খালি করতে অনেক হাসপাতাল অন্য রোগীদের আগেভাগেই ডিসচার্জ করে দিচ্ছে। ফলে দেশে ফিরতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন এরকম কয়েক হাজার বাংলাদেশী।
এনওসির জন্য শত শত আবেদন
এনওসি‘র জন্য দিল্লিতে হাই-কমিশন ছাড়াও মুম্বাই এবং কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনেও এনওসি চেয়ে প্রতিদিন শত শত আবেদনপত্র জমা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি আবেদন হচ্ছে কলকাতায় বাংলাদেশে ডেপুটি হাই কমিশনে। ‘প্রতিদিন আমাদের এখানে ৩০০ থেকে ৫০০ আবেদন পড়ছে,’ নাম না প্রকাশ করার শর্তে সেখানকার একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান।
কিন্তু এনওসি দেয়ার সময় বেনাপোল সীমান্তের ওপাশে কোয়ারেন্টিন সুবিধার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভিসার মেয়াদ যাদের শেষ হয়ে যাওয়ার পথে তাদেরকে বা যারা মারা যাচ্ছেন তাদের এবং স্বজনদের আবেদনপত্রকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
তারপরও, সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর গত ১৫ দিনে কলকাতা ডেপুটি হাই-কমিশন থেকেই প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশীকে দেশে ফেরার জন্য ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে কলকাতার ওই কর্মকর্তা জানান, বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রোববার থেকে ঈদ পর্যন্ত আটকে পড়া বাংলাদেশীদের দেশে ফেরার এনওসি দেয়া বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ওদিকে যশোরের সাংবাদিক সাজেদ রহমান জানিয়েছেন, ভারত থেকে ফেরত লোকজনকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে শহরের ১৮টি হোটেল বুক করা হয়েছে। সেগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায়, আশপাশের কয়েকটি জেলা শহরের হোটেলেও তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
ভাইরাস নিয়ে ফিরছেন অনেকে
শনিবার সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারত থেকে ফেরা দুজনের শরীরে নিশ্চিতভাবে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে যা নিয়ে সরকারের মধ্যে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
যশোর থেকে সাংবাদিক সাজেদ রহমান বলছেন, গত ১৫ দিনে ভারত থেকে ফেরা ২৫ জন কোভিড পজিটিভ হয়েছেন বলে তাকে জানিয়েছেন যশোরের ২৫০ বেড হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: দিলিপ কুমার রায়। এখনো ওই হাসপাতালে ১৭ জন ভর্তি রয়েছেন।
ভারত থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখলেই তাদের এই হাসপাতালের নিয়ে আসা হচ্ছে এবং নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে।
সূত্র : বিবিসি