২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ১১:৪৭
২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ১১:৪৭

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আতঙ্কিত নয়, সাবধান হোন

মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (কালো ছত্রাক) বিশেষ ধরনের অনুবীক্ষণিক ছত্রাকের সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগকে বোঝায়। এর মধ্যে রাইজোপাস প্রজাতি হলো সবচেয়ে বেশি দায়ী, তবে অন্যান্য জীবাণু যেমন- মিউকর, কানিংহামেলা, অ্যাফোফিজোমাইসেস, লিচথিমিয়া, সাকসেনিয়া, রাইজোমুকর এবং অন্যান্য প্রজাতিও এই রোগের কারণ।

এই ছত্রাক সর্বব্যাপী- মাটি পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে থাকলেও সংক্রমণ ক্ষমতা এতই কম যে এক লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ১-২ জনের এই জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবল এই সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারেÑ যেটা এক লাখে ২০ থেকে ৩০ জন হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগী, বিশেষত কিটো অ্যাসিডোসিস আক্রান্তরা এই ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। তা ছাড়া ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, অতিরিক্ত ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অত্যধিক স্টেরয়েডস গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্য কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ হতে পারে। চামড়ার গভীর ক্ষত ও পোড়া ঘায়েও এই রোগ হতে দেখা যায়। ইদানীং ভারতের কোনো কোনো স্থানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এই রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়নি।মিউকর পরিবেশে মোল্ড হিসেবে থাকলেও শরীরের অভ্যন্তরে ঢুকে হাইফা বা তন্তু আকারে পরিণত হয়। এগুলো বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ছত্রাকের হাইফাগুলো রক্তনালীতে আক্রমণ করে, যা থেকে থ্রম্বোসিস ও টিস্যু ইনফ্রাকশন, নেক্রোসিস এবং পরিশেষে গ্যাংরিন তৈরি হয়। সুস্থ মানুষের রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা বা নিউট্রোফিল এই ছত্রাকের বিরুদ্ধে মূল প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। সুতরাং, নিউট্রোপেনিয়া বা নিউট্রোফিল কর্মহীনতায় (যেমন- ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড ব্যবহার) আক্রান্ত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। একই কারণে এইডস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই সংক্রমণের হার বেশি দেখা যায়।আক্রান্ত অঙ্গের ওপর ভিত্তি করে মিউকরমাইকোসিস রোগটি ৬ ধরনের। যথা : (১) রাইনো সেরেব্রাল- নাক, নাকের ও কপালের সাইনাস, চোখ ও ব্রেইন বা মস্তিষ্কের সংক্রমণ, (২) ফুসফুসীয়, (৩) আন্ত্রিক, (৪) ত্বকীয়, (৫) অভ্যন্তরীণ বা ডিসেমিনেটেড এবং (৬) অন্যান্য । এই ছত্রাক মানুষের শ্বাসনালী ও নাকের মধ্য দিয়ে, খাবারের সাথে বা ত্বকের কোনো ক্ষত বা প্রদাহের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে থাকে। আক্রান্ত অংশ আর নাকের শ্লেষ্মা, কফ, চামড়া ও চোখ কালো রঙ ধারণ করে বলে একে কালো ছত্রাক নামে ডাকা হয়। মিউকরমাইকোসিস আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না করতে পারলে ৫০% থেকে ৮০% রোগী মৃত্যুবরণ করে থাকে। আর অভ্যন্তরীণ সংক্রমণে মৃত্যুর হার ১০০% এর কাছাকাছি।রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা : ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের শুরুতে রোগ সন্দেহ ও নির্ণয় করা অত্যাবশ্যক। রক্ত পরীক্ষা, বুক ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গের এক্সরে, আল্ট্রাসনো, শ্লেষ্মা, চামড়া ও মাংসের টিস্যু বায়োপসি, সিটিস্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষা করাতে হবে। উচ্চ মৃত্যু হারের ভয় থাকায় সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ছত্রাক বিরোধী ওষুধ বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ জরুরিভাবে শুরু করতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিগুলো যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত অঙ্গে সার্জারি করতে হতে পারে বা কোনো কোনো সময়ে তা কেটে ফেলে দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হতে পারে।ইদানীং ভারতের মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রদেশে মারাত্মক কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যে নতুন করে দেখা দিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস। দীর্ঘদিন রোগভোগ, অতিরিক্ত স্টেরয়েড ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয়। ভারতজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হলেও শুরুতেই ভালোমতো চিকিৎসা করলে এই রোগ দমন করে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। গত সপ্তাহে ভারতে কোভিড রোগীদের হোয়াইট বা শ্বেত ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দেয়ায় বাড়তি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কালো ছত্রাকের মতো শ্বেত ছত্রাকের উপসর্গ ও চিকিৎসা একই রকম হলেও এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।প্রধানমন্ত্রীর সঠিক পরিকল্পনা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আমরা কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছি। আমাদের দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কোনো রোগী এখনো পাওয়া যায়নি। হোয়াইট ফাঙ্গাসের কোনো রোগীর খবরও পাওয়া যায়নি। আশা করি সতর্কতা অবলম্বন করলে এই রোগ থেকে সবাই নিরাপদ থাকতে পারবে। তারপরও যদি সংক্রমণ ঘটে ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই রোগের ওষুধ আমাদের হাতে রয়েছে, সঠিকভাবে প্রয়োগ করে আমরা রোগীর নিরাময় নিশ্চিত করতে পারব। সুতরাং আতঙ্ক নয়, সাবধানতা দরকার।

Facebook
Twitter
LinkedIn