নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ির বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম মুন্না নগর প্লাজায় ব্যবসা করতেন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ‘শিরোনামহীন’ নামে নিজস্ব একটি পোশাকের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। সাইনবোর্ড এলাকায় একটি কারখানা ভাড়া নিয়ে টি-শার্ট, পোলো শার্ট বানিয়ে নিজের দোকানে বিক্রি করতেন। ভালোই চলছিল দিনকাল। গেল ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ অভিযান চালায়। সেই অভিযানে ৯১১টি দোকানের মধ্যে মুন্নার দোকানও ভাঙা পড়ে। এরপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরও নিঃস্ব করে দেয়। শুধু মুন্না নন, হাজারখানেক উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ঘুরে দাঁড়ানোর এক বুক আশা নিয়ে তারা তাকিয়ে ছিলেন বাজেটের দিকে, যদি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু হায়! বাজেটে ছোট উদ্যোক্তাদের করোনাকালীন দুঃখ-দুর্দশার কথা উঠে আসেনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাপক কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। করপোরেট কর, অগ্রিম আয়কর, ভ্যাটের আগাম কর এবং জরিমানা-সরল সুদ, ন্যূনতম কর কমানো হয়েছে। নতুন ভারী শিল্প স্থাপনে ভ্যাট অব্যাহতি-কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের দুহাত ভরে দিয়েছেন। কিন্তু অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার বেলায় হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। যদিও বাজেট বক্তৃতায় এসএমই খাতের অবদান তুলে ধরতে ভুল করেননি।
বাজেট বক্তৃতার ৮১ পৃষ্ঠায় অর্থমন্ত্রী এসএমই প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের (এসএমই) গুরুত্ব অপরিসীম। স্বল্প পুঁজি ও উৎপাদনকাল নির্ভর এসএমই খাতে সবার অংশগ্রহণের সমান সুযোগ তৈরির জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা ও শিল্প শ্রমিক তৈরির লক্ষ্যে সরকার অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করতে সরকার অতিক্ষুদ্র, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধাসহ একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করেছে, যার বেশির ভাগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। এসএমই খাতে সরকারের এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ২০২৪ সালের মধ্যে শতকরা ৩২ ভাগে উন্নীত হবে। ১৬১ পৃষ্ঠায় প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় উপকারভোগীদের সংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ৯৫ হাজার ৪০৭টি প্রতিষ্ঠান এ প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য যা রেখেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-নারী উদ্যোক্তাদের কর অব্যাহতির সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ লাখ টাকা করা হয়েছে। হালকা প্রকৌশল শিল্পে কর অবকাশ ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যন্ত্রপাতি বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে এক শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে শুল্ক নীতির সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এক শতাংশ শুল্ক দিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত সব মেশিন আনতে পারবেন। এক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বিষয়ক একটি ঝামেলা ছিল। সেটা দূর করতে আয়কর অনুবিভাগকে বলা হয়েছে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই খাতের অবদান সরকার মুখে মুখে স্বীকার করে। আর্থিক ও রাজস্ব নীতি গ্রহণের তার প্রতিফলন দেখা যায় না। বড়দের কথা মাথায় রেখে নীতি গ্রহণ করা হয়। ছোটরা সব সময় উপেক্ষিত থাকে। সরকার করোনা মোকাবিলায় যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার সুফল প্রকৃত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পাননি। বরং বড়রা ছোট সেজে সেই ফায়দা লুটেছে। ব্যাংক ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না।
ক্ষতিগ্রস্ত সেই নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম মুন্না বলেন, গত বছর মার্চ থেকে করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা শুরু হয়। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ডিসেম্বরে সিটি করপোরেশন দোকান ভেঙে দিয়েছে। সিটি প্লাজা, নগর প্লাজার হাজারখানেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। শুনেছি করোনায় সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ দিতে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। সেই তহবিল ঋণ পেতে ব্যাংকে গেলে জানানো হয়, আমরা সেই ঋণ পাব না। নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে অন্য ঋণ চাইলে এই কাগজ-সেই কাগজ লাগবে বলে অনেক দিন ঘুরিয়েছে। পরে ঋণ আর দেয়নি।
প্রস্তাবিত বাজেটে শর্তসাপেক্ষে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে প্রস্তুতকৃত যন্ত্রাংশ সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শর্ত হচ্ছে, দেশের ভারী শিল্পকে যেসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেসব যন্ত্রাংশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত উৎপাদনের পর তা সরবরাহ করলে ভ্যাট দিতে হবে না। অবশ্য এজন্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধিত হতে হবে এবং রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এ বিষয়ে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দিকে তাকানোয় ধন্যবাদ। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পাড়বে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ শিল্পের উপযোগী যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মেশিনপত্র আপগ্রেড করতে হবে। এজন্য প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে, ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যাংক টাকা দিতে চায় না। অর্থায়ন সমস্যা সমাধান করা গেলে যন্ত্রাংশ বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব।
প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের কর অব্যাহতির সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ লাখ টাকা করা হয়েছে। তবে ভ্যাট খাতে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এবং টেকসই উন্নয়নে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনীতিতে উদ্যোক্তা হিসাবে পুরুষের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়লে নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।
এ বিষয়ে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (ওয়েন্ড) ড. নাদিয়া বিনতে আমিন বলেন, বাজেটে আয়করে ছাড় দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে নারী উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ভ্যাটের হয়রানির শিকার হন। নোটিশ না করেই অকস্মাৎ খাতাপত্র নিয়ে যাওয়া হয়। তাই ভ্যাটের টার্নওভার সীমা বাড়ানো দরকার ছিল। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তা প্রণোদনার টাকা পাননি। বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ফর্ম বানালেও বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ নিতে সব ধরনের কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে। কোনো একটির ঘাটতি থাকলে ঋণ পাওয়া যায় না। নারীদের সহজে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নারী উদ্যোক্তাদের চেম্বার-অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে কাজে লাগানো যায় বলে মনে করেন তিনি।