ঢাকাই চলচ্চিত্রের আলোচিত নায়িকা পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর আলোচনায় এসেছে তার পূর্বপরিচিত তুহিন সিদ্দিকী অমির নাম। উচ্চপর্যায়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কানেকশন থাকার বদৌলতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসার আড়ালে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ মিলছে তার বিরুদ্ধে।
অবৈধভাবে বিদেশে নারী ও শ্রমিক পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে এই অমি। পুলিশ বলছে, পরীমণিকাণ্ডের নাটের গুরু এই যুবক। পরীকে আবাসন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের কাছে তুলে দিয়েছিলেন অমি।তবে বোট ক্লাবের সিসিটিভির ফুটেজ বলছে, ঘটনার রাতে স্বাভাবিকভাবে সেখানে ঢুকেছিলেন নায়িকা পরী ও অমিসহ চারজন। অমির গাড়ি থেকেই নামেন পরী। পৌনে দুই ঘণ্টা পরে অসুস্থ অবস্থায় বের করা হয় আলোচিত এই নায়িকাকে। পরী-অমির গভীর সম্পর্কের নেপথ্যে কী তাও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
ডিবি সূত্র জানায়, রিমান্ডে থাকা নাসির ও অমিসহ পাঁচজনকে টানা জেরা করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেও পরীকেও দুষছেন আসামিরা। তারা বলেছেন, সেখানে তর্কবির্তক হলেও ধর্ষণ কিংবা হত্যাচেষ্টা হয়নি। আগ থেকেই পরী মদ্যপ ছিলেন বলেও দাবি করছে নাসির ও অমি। তবে ভেতরে কিছু না হলে পরী অসুস্থ অবস্থায় বের হওয়ার কথা নয়।
অন্যদিকে নায়িকা পরীমণি বোট ক্লাবের ঘটনার আগের রাতে গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবেও তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ মিলেছে। তিনি ওই ক্লাবে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছিলেন। সেখানে তিনি ভাঙচুর চালিয়ে উল্টো পুলিশকে ফোন করে কর্তৃপক্ষকে হেনস্তা করার হুমকি দিয়েছিলেন। বুধবার সন্ধ্যায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানায়।
এদিকে পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার তুহিন সিদ্দিকী অমির নামে রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে তার অফিসে অভিযান চালিয়ে শতাধিক পাসপোর্ট জব্দ করেছে পুলিশ। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত অমির দুই সহযোগী বাছির ও মশিউর মিয়ার দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। দক্ষিণখান এলাকার একটি অফিস থেকে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
কে এই অমি: পরীমণির ইস্যুতে আলোচনায় আসছে বার বার অমির নাম। কে এই অমি? কি তার পরিচয়? মধ্যরাতে যে বন্ধুর সঙ্গে বোট ক্লাবে যান চিত্রনায়িকা পরীমণি, সেই তুহিন সিদ্দিকী অমি তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় সহযোগিতা করেন। পরীমণি নিজেই স্বীকার করেছেন দুই বছর ধরে অমির সঙ্গে তার পরিচয়। তার পোশাকশিল্প জিমি বাল্যবন্ধু হিসেবে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা।
তবে বোট ক্লাব ঘটনার পর পরীমণি যে মামলা দায়ের করেছেন সে মামলায় দুই নম্বর আসামি হচ্ছেন অমি। তিনি নায়িকাকে ফাঁদে ফেলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা যায়, অমি ক্লাবপাড়ায় একজন পরিচিত মুখ। তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন এক সময় বিদেশে ছোটখাটো চাকরি করতেন। এরপর দেশে ফিরে এসে বিদেশে শ্রমিক এবং নারী পাঠানোর ব্যবসা শুরু করেন অমির বাবা তোফাজ্জল হোসেন। এই নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তথ্য ও উঠে এসেছে এই অমির বিরুদ্ধে। অমিদের সংসারে ভাগ্য ফিরে যখন ছেলে অমি আশকোনা এলাকায় সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন।
এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে নারী পাচার করেই প্রচুর অর্থ কামান অমি। বর্তমানে অমি এবং তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। ঢাকার উত্তরা ও আশকোনায় তাদের একাধিক বাড়ি ও প্লট রয়েছে বলে জানা যায়। দক্ষিণখান এলাকায় রয়েছে আলিশান জাপানি কটেজ। সম্পূর্ণটাই জাপানি ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে কটেজটি।
শত শত শ্রমিক এবং নারীদের বিদেশে পাঠিয়ে ও প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অমি এবং তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সূত্র ধরে সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে অমির পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। অমিদের একাধিক আলিশান বাড়িতে রয়েছে সুইমিংপুলও। তাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। সেখানে অনেক সম্পদ গড়েছেন তিনি। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমও গড়েছেন অমি। দক্ষিণখানে একটি রিসোর্টের আড়ালে প্রায় প্রতিদিন মদ-জুয়ার আসর বসাতেন তিনি। ওই রিসোর্ট তার ‘রঙশালা’ নামে পরিচিত।
আগের রাতে অল কমিউনিটি ক্লাবেও পরীমণির তুঘলকি কাণ্ড! নায়িকা পরীমণি বোট ক্লাবের আগের রাতে গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবেও তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ মিলেছে। গুলশান-২ এলাকার অল কমিউনিটি ক্লাব কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে গুলশান থানায় এ সংক্রান্তে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, বোট ক্লাব ঘটনার আগের দিন গত ৭ জুন রাতে কমিউনিটি ক্লাবে ভাঙচুরের অভিযোগে তার (পরীমণির) বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
ওই জিডিতে পরীমণির বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে? জবাবে সুদীপ বলেন, ক্লাব কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে যে, উনি (পরীমণি) আনঅথরাইজড ওখানে গেছেন। তারপর ক্লাব মেম্বারসদের যে জায়গা ছিল, ওখানে নাকি বসতে চেয়েছেন, তারপর নাকি ভাঙচুর করেছেন। এইগুলো আর কি!
এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে অল কমিউনিটি ক্লাবের সভাপতি কে এম আলমগীর ইকবাল বলেছেন, ঘটনার দিন পরীমণি একজন সদস্যের মাধ্যমে কয়েকজনকে নিয়ে ক্লাবে আসেন। তার পোশাক দেখে ক্লাবের একজন সদস্য আপত্তি তোলেন। তাকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু পরীমণি তার কথা না শোনায়, তিনি নিজেই চলে যান। পরীমণি যে সদস্যের মাধ্যমে এসেছিলেন তিনিও পরীমণিকে চলে যেতে বলেন। পরীমণি কথা না শোনায় একপর্যায়ে ওই সদস্যও চলে যান।
আলমগীর ইকবাল বলেন, পরীমণি তখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে গ্লাস, ছাইদানি ছুড়ে মারতে থাকেন। পরীমণির সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা ৯৯৯ এ কল করেন। পুলিশ আসার পরও তিনি এগুলো ছুড়তে থাকেন। তখন ক্লাবের দুজন ওয়েটার ছিল। এ সময় পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের অভিযোগ শোনেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশের অনুরোধে পরীমণি ও অন্যরা চলে যান।
জানতে চাইলে পরীমণি বলেন,‘এটা ফালতু একটা অভিযোগ। এত দিন পরে কেন এই অভিযোগ?’ এর আগে, পরীমণি অভিযোগ করেছেন, রাজধানীর অদূরে সাভারের বিরুলিয়ায় ‘ঢাকা বোট ক্লাবে’ গত ৮ জুন রাতে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা ও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। সেই ঘটনায় তিনি ওই ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ, সেদিন তাকে নিয়ে যাওয়া অমিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় এজাহার দায়ের করেন গত সোমবার।
একপর্যায়ে সেদিন রাতেই রাজধানীর উত্তরায় অমির বাসা থেকে ৩ রক্ষিতাসহ গ্রেফতার হন নাসির ও অমি। গ্রেফতার হওয়ার আগে পরীমণির বিষয়ে মুখ খুলেন আবাসন ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বোট ক্লাব থেকে দামি ড্রিংকস (মদ) জোর করে নেয়ার চেষ্টা করেছিল পরীমণি ও তার সহযোগীরা। তারা তো আমাদের ক্লাবের মেম্বার না। তাই আমি তাদের নিতে দেইনি। এ কারণে তাকে আমি বাধা দিয়েছি এবং বলেছি যে- এটা নেয়া যাবে না। নিতে হলে অবশ্যই তোমাদের মেম্বার হতে হবে।’
ক্লাবের মেম্বার ছাড়া ওই মদ যে কারো কাছে বিক্রয়যোগ্য নয় উল্লেখ করে নাসির বলেন, ‘আমি পরীমণিকে বলেছি- এটা বিক্রয়যোগ্য না। তা ছাড়া এতো রাতে আমাদের বার ক্লোজড্। তাই কোনোভাবেই সম্ভব না। তবে তার আগেই কোথা থেকে যেনো পরীমণি মদপান করে এসেছিল। ওই অবস্থাতেই আমাদের কাছে দামি মদ না পেয়ে সে উত্তেজিত হয়ে যায়, আমার উপর চড়াও হয় এবং বারের মধ্যেই একটার পর একটা কাঁচের গ্লাস ভাঙচুর করে। ওই সময়ে আমাকে সে গালিগালাজ করে। তখন আমাদের স্টাফরা তাকে থামানো চেষ্টা করে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী বলেন, কালো রঙের একটি গাড়িতে ওই রাত ১২টা ২২ মিনিটে পরীমণি ক্লাবে ঢোকেন, আর বের হন ১টা ৫৯ মিনিটে। বের হওয়ার সময় তাকে দুজন চ্যাংদোলা করে বের করতে দেখা যায়।
ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, মারামারির কথা দুজনই স্বীকার করেছেন। প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।