আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। প্রতি বছর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হলেও এবার করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর বৈশ্বিক মহামারীর কারণে স্থানীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না। তবে বছরব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা করা হচ্ছে।
বিশ্বের ভয়ঙ্কর ও সুন্দর প্রাণী হিসাবে পরিচিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন। এই মুহূর্তে সুন্দরবনে এখন কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক তথ্য নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে হয়নি স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো বাঘশুমারি।এ প্রসঙ্গে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ খুলনা বিভাগীয় কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল এক প্রশ্নের জবাবে মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার কারণে এ বছর বিশ্ব বাঘ দিবস স্থানীয়ভাবে পালিত হবে না। ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪টি।’বনরক্ষীদের ধারণা মতে, বর্তমানে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কয়টি বেড়েছে তা পুনরায় জরিপ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাঘ জরিপের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
খুলনা সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষায় আগের চেয়ে সরকারের নজরদারি ও তৎপড়তা বেড়েছে। বাঘ সংরক্ষণে ব্যবস্থাপনা আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবন সংরক্ষণে আলাদা মন্ত্রণালয় বা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে।
গ্লোবাল টাইগার ফোরামের সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে। টাকার লোভে চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা সবসময় তৎপর থাকে। সুযোগ পেলে বাঘ ও হরিণ শিকার করার চেষ্টা করে। যে কোনো উপায়ে এসব বাঘ শিকারিদের প্রতিরোধ করতেই হবে।’
নবিভাগ দাবি করছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই। গত দুই বছরে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্চ থেকে র্যাঞ্চ ৩টি বাঘের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে বার্ধক্যজনিত কারণে বাঘ তিনটি মারা গেছে। উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজার সংলগ্ন এলাকা থেকে বাঘের চামড়াসহ একজনকে আটক করা হয়েছে।
গবেষকদের দাবি- বাঘ থাকলেই সুন্দরবন থাকবে। তাদের মতে, বাঘই হচ্ছে একটি আদর্শিক বনের ‘ইন্ডিকেটর’ বা ‘নির্ধারক’। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘যে কোনো মূল্যে বাঘের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই হবে। তা না হলে চরম হুমকির মুখে পড়বে সুন্দরবন। বাঘ ও সুন্দরবন সুরক্ষায় প্রয়োজন আলাদা ইউনিট গঠন।’
বনবিভাগ জানায়, বনের জীব-বৈচিত্র্য, খাদ্য শৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে বাঘ। বাঘ বনরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। যে বনের অবস্থা ভালো সেখানে বাঘের সংখ্যা বেশি থাকে। বাঘ কমে যাওয়ার মানে হচ্ছে বনাঞ্চলের অবস্থা ও বাঘের আবাসস্থল বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। সে কারণে মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির বাঘ রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশ বিদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এক সময় সোচ্চার হয়ে ওঠে। বাঘ সংরক্ষণের অর্থ কেবল একক প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নয়। তার সাথে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের খাদ্য, আবাস নিরাপত্তা ও প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের শিকারি ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তাদাতা হচ্ছে- রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
বনবিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘের প্রথম জরিপ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার বাঘের জরিপ পরিচালিত হয়। ১৯৭৫ সালে বুবার্ট হ্যান্ড্রিস ১১টি কমপার্টমেন্ট পরিদর্শন ও মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের জরিপে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫০টি, ১৯৮২ সালে সল্টার নমুনা মাঠ জরিপে ৪৫২টি, ১৯৮৪ সালে গিটিন্স আকন্দের সরাসরি বাঘ দেখা ও পদচিহ্ন নিরূপণ জরিপে ৪৩০-৪৫০টি, ১৯৯২ সালে বনবিভাগের জরিপে ৩৫৯টি, ১৯৯৩ সালে তামাঙ্গ ও দের জরিপে ৩৬২টি।
২০০৪ সালে, বনবিভাগ ইউএনডিপি ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দলের জরিপে ২১টি বাচ্চাসহ ৪৪০টি, ২০০৯ সালে বনবিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ জরিপে সর্বশেষ বাঘ ছিল ৪০০-৪৫০টি।
কিন্তু ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০৬-এ। এ খবর ছড়িয়ে পরায় বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪৯ দিনে ১ হাজার ৬৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২৩৯ জায়গায় গাছের সাথে ৪৯১টি সর্বাধুনিক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে জরিপে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪ টিতে।