২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ৮:৪১
২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ৮:৪১

এক বাতি ৭০ হাজার টাকা!

উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় পণ্যের দর দেখলে চোখ ছানাবড়া হয় যায়। যেন দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে। কক্সবাজার পৌরসভার রাস্তার জন্য প্রতিটি ১০০ ওয়াট এলইডি লাইটের দাম ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ৬৯০ টাকা, যা মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদের হতবাক করেছে। প্রকল্পের প্রস্তাবনা থেকেই এই দুর্নীতি শুরু হয়। এরপর পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ছাড় করাতে পারলেই কেল্লাফতে। কারণ পিইসির সুপারিশ ছাড়া একনেকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের সুযোগ নেই। প্রস্তাবনাগুলোতে জিনিসপত্রের দেয়া দর আজগুবি ও অবাস্তব। দাম শুনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমি বিস্মিত, হতভম্ব ও চিন্তিত। লাইটগুলোর স্থায়িত্ব কত দিনের? অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দামটি অত্যধিক বললেও কম হবে এক কথায় এটি হাস্যকর।

প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ‘কক্সবাজার পৌরসভা এলাকার রাস্তার জন্য এলইডি বাতি সরবরাহ ও স্থাপনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের কাছে অনুমোদনের জন্য দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ভৌত অবকাঠামো বিভাগে প্রকল্পটি নিয়ে মূল্যায়ন কমিটির জুমে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে বলা হয়, কক্সবাজার একটি পর্যটন শহর। প্রতিদিন দেশী-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক কক্সবাজারে আসেন। নিরবচ্ছিন্ন নাগরিকসেবা প্রদান করতে কক্সবাজার পৌরসভাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেবার মান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত আলোক ও নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রয়োজন। তাই আধুনিক ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি সড়কবাতি ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।

খরচের হিসাব থেকে জানা গেছে, প্রস্তাবনায় প্রতিটি ১০০ ওয়াট এলইডি লাইটের দাম ৬৯ হাজার ৬৯০ টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ৪০ ওয়াট এলইডি লাইট ৩১ হাজার ৯৭১ টাকা, প্রতিটি ৬০ ওয়াট ৫৫ হাজার ৩২১ টাকা এবং প্রতিটি ৮০ ওয়াট ৬৬ হাজার ৬৯৭ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু এইসব লাইটের দরের পেছনে কোনো মার্কেট যাচাই করা হয়নি। প্রস্তাবিত প্রকল্পে গাড়ি কেনার কোনো প্রস্তাব না থাকলেও পেট্রল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ ব্যয় চাওয়া হয়েছে। ব্যয় চাওয়ার বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা চেয়েছে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।

চীনা বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, কোম্পানি ও লাইটের মান ভেদে প্রতিটি সেটের দাম ১২ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১৭৮ ডলার পর্যন্ত রয়েছে; যা স্থানীয় টাকায় ৮৫ টাকা হিসাবে ডলারের বিনিময় মূল্য ধরলে সর্বনিম্ন এক হাজার ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ১৩০ টাকা হয়। চীনের জংসান ইয়াই লাইটিং কোম্পানির দর ৩২.৫ থেকে ৮৪.৫ ডলার প্রতিটি সেটের। হাংজুয়া টেকনোলজির ওয়েব তথ্যানুযায়ী প্রতিটি এলইডি সেটের দাম ১২ থেকে ৬৫ ডলার পর্যন্ত। প্রতিটি বাতি ওয়াটার প্রুভড। এ ছাড়া ইয়াংজু বেস্টার্ন ইন্টার. ট্রেডিং কোম্পানির সোলার এলইডি ওয়াটার প্রুভড লাইটের সেটের দাম ২০ থেকে ১৫০ ডলার। এগুলো সাড়ে ৭ থেকে ৪২০ ওয়াটের। এ ছাড়া ইয়াংজু ইয়াংফেং নিউ এনার্জি টেকনো. কোম্পানি লিমিটেডের ১৪৮ থেকে ১৭৮ ডলার। এ দিকে সিএন সরবরাহকারীর তথ্য অনুযায়ী সেটসহ ৬০ ওয়াটের প্রতিটি লাইটের দাম সর্বোচ্চ ২৯৮ ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় ২৫ হাজার ৩৩০ টাকা। এদের সর্বনি¤œ দর হলো ৮৫ ডলার।

এলজিইডি ও কক্সবাজার পৌরসভা সভা জানায়, এলজিইডির সিটি গভর্ন্যান্স প্রজেক্টের আওতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এলইডি সড়কবাতির দর এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ওয়েস্টার্ন ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী এলইডি বাতির বর্তমান বাজারদর, বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্য সমন্বয়ে ব্যয় নির্ধারণ করার জন্য বলেছে। একইসাথে কেনা বাতি এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির দাম নির্ধারণের জন্য কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে কমিশন। এই কমিটর মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা হবে। কমিটির সব সদস্যের সিল স্বাক্ষর ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংযোজন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। বর্তমানে কক্সবাজারে সড়ক বাতির সংখ্যা ১ হাজার ৬০০টি এবং রাস্তা ১১৪ কিলোমিটার বলে সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিধি অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প থাকলে সেসবের অনুমোদনের ক্ষমতা পরিকল্পনামন্ত্রীর। এর বেশি হলেই সেটিকে একনেকে উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক। আর ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প থাকলে সেখানে সম্ভাব্যতা যাচাই করা আবশ্যিক।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: মামুন আর রশীদের কাছে প্রকল্পে লাইটের দাম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানান, আমাদের কাছে দাম বেশি মনে হয়েছে। তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়ে বলেছি, কমিটির মাধ্যমে এগুলোর দাম নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য। বর্তমানে এই সব কাজ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। বিদ্যুৎ সম্পর্কিত যেসব কাজ আছে সেগুলো তাদের সাথে কথা বলে তাদের মাধ্যমে করানোর জন্য বলা হয়েছে। কারণ তারা নিজেরা লাইট এনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের লাইট ফেলে দেবে। এতে সরকারের অর্থের অপচয় হবে। পিডিবিকে সাথে নিয়েই যেন এসব করে।

এই দাম তো প্রশ্নই আসে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমিটি যাচাই করে সেই সব দর কোথায় তারা পেয়েছে তার তালিকা ও রেফারেন্স উল্লেখ করে দেবে। মার্কেট যাচাই করে দিতে হবে।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছে ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি বিস্মিত, হতভম্ব ও চিন্তিত। আমার কাছে ফাইলটি এখনো আসেনি। কেন একটি লাইটের এত দাম হবে প্রশ্নে তিনি বলেন, ফাইল এলে আমি অনুমোদনের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্যের (সচিব) কাছে বিষয়টি জানতে চাইব।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, ওই পৌরসভা হলো প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই হয়ে এটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তাহলে ওই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী করেছেন? বিষয়টি কি যাচাই করার সময় তাদের চোখে পড়েনি?

তিনি বলেন, এরপর এটা আসে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে। তারা এটা কিভাবে অনুমোদন দেন। তারা ডিপিপির এইসব কিভাবে এড়িয়ে যায়। এসব ধরা তাদের দায়িত্ব। এসব ধরার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। এটা কমনসেন্সের ভিত্তিতেই প্রশ্ন করা যায়। কিভাবে এসব পার হয়ে যাচ্ছে?

তার মতে, এগুলো হলো হাস্যকর দাম। এসবের যৌক্তিকতার কোনোই প্রশ্ন আসে না। এসব মারাত্মকভাবে অতিরঞ্জিত। পরিকল্পনামন্ত্রী কতগুলোকে ধরবে। এসব ধরার জন্যই পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা কিভাবে ঘটে? এসবের জন্য দায়ী কে?

তিনি বলেন, এ ধরনের ব্যয়গুলো সবই সরকারি বিনিয়োগ হিসেবে চলে আসছে জাতীয় আয়ের হিসেবে। আমরা তো বলি সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৮ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। এতে বাহবা আর করতালি হচ্ছে। এগুলো কী বিনিয়োগ হলো? বিনিয়োগ তো হচ্ছে বাল্বটা। এখানে বিনিয়োগের হিসাবটাও মারাত্মকভাবে অতিরঞ্জিত হয়ে যায়। কারণ হাজার টাকার বাল্ব দেখানো হচ্ছে কয়েক হাজার টাকায়।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো: আবদুর রশীদ খানের সাথে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।

Facebook
Twitter
LinkedIn