ইভ্যালিসহ প্রতারিত ১২ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনও পাওনা আদায়ে কাজ করতে পারছে না। এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা হচ্ছে দেওয়ানি আইনে। নিবন্ধন দেওয়ার পরও রেজিস্ট্রার অব জয়েনস্টক কোম্পানি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪২০ ধারায় মামলা হয়েছে। ধারাটি জামিনযোগ্য। ফলে যে কোনো সময়ে গ্রেফতারকৃতরা বৈধভাবেই জামিনে বেরিয়ে আসতে পারেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বহুল আলোচিত ইভ্যালি নিবন্ধন নিয়েছে রেজিস্ট্রার অব জয়েনস্টক কোম্পানি (আরজেসি) থেকে। কিন্তু ই-অরেঞ্জ, ধামাকা কোনো নিবন্ধন নেয়নি। এতদিন ব্যবসা পরিচালনা করছে শুধু একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে। বাকি প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একই।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা চাপ সৃষ্টি করতে পারি ইভ্যালির ওপর। প্রকৃত অর্থে আমাদের আইনের কিছু দুর্বলতা আছে। এই আইনে আটকে আছি। তবে নতুনভাবে যাতে ই-কমার্স খাতে এ ধরনের প্রতারণা না হয় এজন্য এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। আইনমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। তিনি কাজ করছেন। একটি আইন করে তার বিধিমালা করা হবে। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও সহায়তা লাগবে। মন্ত্রী আরও বলেন, ইভ্যালি চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪২০ ধারায়। এটি জামিনযোগ্য ধারা। তারা জামিনে বের হতে পারে।
প্রসঙ্গত নীতিমালা এবং আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১১০০ কোটি টাকা পকেটে ভরেছে। ইভ্যালিও নিয়েছে ১০০০ কোটি টাকা। এছাড়া ধামাকা নিয়েছে ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি টাকা, এহসান গ্র“প ১১০ কোটি টাকা, নিরাপদডটকম ৮ কোটি টাকা, চলন্তিকা ৩১ কোটি টাকা, সুপম প্রডাক্টের ৫০ কোটি টাকা, নিউ নাভানার ৩০ কোটি টাকা এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা, সিরাজগঞ্জশপ ৪৭ কোটি, আলাদিনের প্রদীপ ১০০ কোটি টাকা নিয়েছে।
দেশে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাজারে যাতে কেউ অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য কাজ করছে বাংলাদেশ প্রতিযোগী কমিশন। ইতোমধ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি মামলা করছে। তবে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি প্রতিযোগী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ প্রতিষ্ঠান চলছে দেওয়ানি আইনের ওপর। এর অধীনে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করার প্রমাণ সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে তার বার্ষিক টার্ন ওভারের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে। প্রতিযোগিতা কমিশন কোনো ক্রিমিনাল আইনে পরিচালিত হয় না। তিনি আরও বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই রায় দেওয়া হবে।
টাকা ফেরত পাওয়া প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, গ্রাহকরা টাকা না পেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৪২০ ধারায় মামলা হয়েছে। এখন গ্রাহকদের টাকা ফেরত চেয়ে একটি আবেদন করে আদালতের নজরে আনতে হবে। আবেদনের পর হয়তো আদালত বিবেচনায় নেবে।
জানা গেছে, সিআইডি মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। বেশিরভাগ গ্রাহককে পণ্য বা টাকা ফেরত না দেওয়া সংক্রান্ত। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় এনে এর বিচার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়। কারণ এ আইনে ই-কমার্স খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে মানি লন্ডারিং আইনটি সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদি এটি শেষ পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে।
জানা গেছে, বর্তমান অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম পাওয়া গেছে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চলিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে যথাযথ প্রয়োগ করে প্রতারণামূলক ই-কমার্স ব্যবসাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া দক্ষ জনবল বৃদ্ধিও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যেন তারা আরও সতর্কভাবে ই-কমার্স খাতে ব্যবসা করতে পারে এবং প্রতারণামূলক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে সাবধান থাকতে পারে।