বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের শর্তযুক্ত জামিনের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় অবস্থান নিয়েছে সরকার। আদালতের বাইরে গিয়ে বিষয়টির সুরাহা করার চেষ্টা চলছে। তবে সবার আগে সোনালী ব্যাংক থেকে লোপাট হওয়া আড়াই হাজার কোটি টাকা আদায় নিশ্চিত করতে চায় সরকার।
এরই মধ্যে অর্থ আদায় এবং হলমার্কের চেয়ারম্যান-এমডির শর্তযুক্ত জামিন বিষয়ে একই সঙ্গে উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। টাকা আদায় করে আসামির শর্তযুক্ত জামিন বিষয়ে মতামত চাইলে নমনীয় মনোভাব দেখানোর ইঙ্গিত দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি হলমার্কের পক্ষ থেকে জামিন ও ব্যবসা চালুর অনুমতির শর্তে পাওনা সব টাকা পরিশোধ করতে চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তানভীর মাহমুদ প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্টদের কাছে আবেদনও পেশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, ব্যাংকের পাওনা টাকা আদায় এবং হলমার্কের চেয়ারম্যান ও এমডির শর্তযুক্ত জামিন একই সঙ্গে হতে হবে। পাওনা টাকার বিপরীতে তাদের জামানত হিসেবে পর্যাপ্ত সম্পত্তি দিতে হবে। সোনালী ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে থাকা তাদের সম্পত্তি বিক্রির কর্তৃত্ব দিতে হবে। এর পরই আদালতের বাইরে তাদের শর্তযুক্ত জামিন ও তাদের ব্যবসা চালুর সুযোগ দেওয়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ব্যাংকের বিপুল অংকের টাকা উদ্ধারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নিশ্চিত হলে তখন তাদের জামিনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন পেশ করা হবে। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হলমার্কের কাছ থেকে টাকা আদায়ে প্রয়োজনে আদালতের বাইরে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছে জাতীয় সংসদের হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির একটি সাব-কমিটি। সাব-কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এ প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে টাকা আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে ছয় দফা চিঠি পাঠিয়েছে সোনালী ব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সমকালকে আরও বলেন, ‘আমরা কাউকে জেলে রাখতে চাই না। ব্যাংকের টাকা দিয়ে দেওয়া হলে বিষয়টি নিষ্পত্তির দিকে এগোবে। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে আমি এখনও প্রস্তুত। এখনও সময় আছে। এ নিয়ে আলোচনার দরজা খোলা।’
দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান সমকালকে বলেন, দুর্নীতিবাজরা আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত দিলে সেটা সরকারের লাভ। জাতীয় সংসদের হিসাব সম্পর্কিত সাব-কমিটি ব্যাংকের পাওনা টাকা আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগের যে কথা বলেছে, সেটি একটি ভালো উদ্যোগ। কমিটির সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যমান আইনের আওতায় যতটুকু সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত। ব্যাংকের পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে আসামির শর্ত সাপেক্ষে জামিনের ব্যাপারে দুদকের মতামত চাইলে কমিশন বিষয়টি যাচাই করে মতামত দেবে।
সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান সমকালকে বলেন, তানভীর মাহমুদকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হলে হয়তো তিনি টাকা দিয়ে দেবেন। তবে বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। তবে সংসদীয় সাব-কমিটি যে নির্দেশনা দিয়েছে তার আলোকে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার কাজটা করা হলে পাওনা আদায় কাজের গতি বেড়ে যেত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, আদালতের বাইরে সংসদীয় সাব-কমিটি টাকা আদায়ের যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছে, সেটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। বিভিন্ন দেশে আদালতের বাইরে এমন ঘটনার মীমাংসার উদাহরণ আছে। অর্থ আদায় এক বিষয়, আর প্রতারণার জন্য জবাবদিহিতা আরেক বিষয়। একটার সঙ্গে আরেকটা মেশানো যাবে না। টাকা আদায়ের শর্তে জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এর অর্থ এই নয়- প্রতারণা, জালিয়াতির বিচার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে।
দুদকের মামলায় হলমার্কের আইনজীবী মো. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এখন করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এই সময়ে সোনালী ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ এবং শর্তসাপেক্ষে জামিন বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে। জামিন দেওয়া হলে এখনও তানভীর মাহমুদ ব্যাংকের সব পাওনা পরিশোধ করতে সক্ষম হবেন। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি ‘ঋণ আদায় তদারকি কমিটি’ করা যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ নিয়ে সোনালী ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও হলমার্কের আইনজীবীকে ডেকে কথাও বলেছেন। পরে হলমার্কের পক্ষ থেকে জোরালো ভূমিকা না থাকায় উদ্যোগটি এগোয়নি। এ ব্যাপারে হলমার্কের একজন প্রতিনিধি জানান, তাদের শিল্প গ্রুপের এমডি, চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন ধরে জেলে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। এই পর্যায়ে হলমার্কের মালিকপক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে কথা বলার মতো কেউ নেই। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ ও শর্তসাপেক্ষে জামিন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলার জন্য তানভীর মাহমুদ তার আইনজীবী মো. শফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে জাতীয় সংসদের সাব-কমিটির পাঠানো প্রতিবেদনে আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে পাওনা আদায়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংককে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকও সাব-কমিটির ওই নির্দেশনা পেয়েছে। তারই আলোকে গত কয়েক বছরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সোনালী ব্যাংকের ছয়টি চিঠিতে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুদক; আইন, ভূমি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে পাওনা টাকা আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কারাবন্দি তানভীর মাহমুদ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে গত ২০১৩ সালের ১১ মার্চ, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ২০১৬ সালের ১৭ মে, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ২০১৭ সালের ১৭ মে ও অর্থমন্ত্রীর কাছে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনগুলোতে বলা হয়, বর্তমানে হলমার্ক গ্রুপের ৬৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ৪০ হাজার শ্রমিক বেকার। ৫০০ কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতিসহ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। এগুলো জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় কারখানাগুলো চালুর অনুমতি চেয়েছেন।
চলতি বছরের মার্চে হলমার্কের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলার শুনানিকালে তানভীর মাহমুদ তার আইনজীবী শফিকুল ইসলামকে বলেছিলেন, তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হলে প্রয়োজনে কারখানার পাশে একটি সাবজেলে রাখা হলে তিনি তার সম্পত্তি বিক্রি করে বড় অংকের থোক টাকা পরিশোধ করবেন। এ ছাড়া ব্যবসা চালু করে কিস্তিতে ব্যাংকের সব পাওনা পরিশোধ করবেন। ভারতের সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান সুব্রত রায়কে শর্তসাপেক্ষে সাবজেলে রেখে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার শর্তে আদালতের আদেশে সংশ্নিষ্ট আসামিকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়ার রীতি পৃথিবীর নানা দেশে আছে। হলমার্কের তানভীর মাহমুদ এ ধরনেরই একটি সুযোগ চাচ্ছেন।