জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেই কার্ড নকল করে গত ৭ বছরে ৫ শতাধিক শ্রমিককে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে একটি চক্র। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত আট সদস্যকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-কে এসব জানিয়েছে চক্রটি।
শুক্রবার (৫ নভেম্বর) দিবাগত রাত থেকে শনিবার (৬ নভেম্বর) সকাল পর্যন্ত রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার চক্রের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩। চক্রের সদস্যরা হলো মো. নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১), মো. নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২), মো. রিমন সরকার (২৫), মো. গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০), মো. বদরুল ইসলাম (৩৭), মো. খোরশেদ আলম (২৮), মো. সোহেল (২৭), ও মো. হাবিব (৩৯)। এই সময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমইটি কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, পাঁচটি মোবাইলফোন সেট, একটি চেকবই ও পাঁচটি নকল সিল জব্দ করা হয়।
শনিবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩-এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, ‘কয়েকজন ভুক্তভোগী র্যাব-৩-এ অভিযোগ করেন, একটি চক্র তাদের ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু অভিযোগকারীরা বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানান। টাকাও ফেরত চান। তখন এই মানবপাচারকারী চক্র নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভুক্তভোগীদের দেয়। এসব নকল কার্ড নিয়ে ভুক্তভোগীরা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে তাদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল বলে জানান কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা। একইসঙ্গে বিদেশযাত্রা স্থগিত করেন তারা। তখন ভুক্তভোগীরা তাদের সংশ্লিষ্ট দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে চক্রটি কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর ভিক্টিমদের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই বিষয়ে ভুক্তভোগীদের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩-এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের মাধ্যমে তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ডিএমপি ঢাকা ও কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিযান চালিয়ে চক্রের মূল হোতাসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়।’
চক্রটির স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, ‘মো. নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১) এই চক্রের মূল হোতা। সে দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে সে দেশে আসে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। সে ২০১২ সালে ওয়ার্কপারমিট নিয়ে দুবাই গমন যায়। এরপর দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দেশটির কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাই অবস্থানকারীদের ওয়ার্কপারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়। ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাইম মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে। সে পরিচিতজনদের মাধ্যমে ভিক্টিমদের উচ্চ বেতনে চাকরির কথা বলে দুবাই যাওয়ার টোপ দেয়। ভিক্টিমরা রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নেয়। এরমধ্যে কেউ কেউ ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এভাবে সে ৭ বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ভিক্টিমকে দুবাই পাচার করেছে। মানবপাচার থেকে অর্জিত অবৈধ উপার্জন দিয়ে সেই দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়। নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘নাইমকে তার সহযোগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী রয়েছে। মো. নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২) বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার ভিক্টিমদের যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাহরিয়ারের কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। সে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকেই ভিক্টিমদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। কিন্তু সম্প্রতি কিছু ভিক্টিম বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে শাহরিয়ার তখন বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের শরণাপন্ন হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের মূল হোতা হাবিব ও খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদের আড়ালে রেখে বিশ্বস্ত জনের মাধ্যমে ভিক্টিমদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে নাইম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছিল।’
লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, ‘ভিক্টিমরা বিএমইটি কার্ড দাবি করলে শাহরিয়ার তার চাচা মো. গোলাম মোস্তফা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তখন সুমন জানায়, ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সে ১টি বিএমইটি কার্ড দিতে পারবে। নাইম ভিক্টিমদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের কাছে দেয়। সুমন ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ১টি বিএমইটি কার্ড হিসেবে ওই পাসপোর্ট বদরুলের কাছে দিয়ে দেয়। বদরুল ১ হাজার টাকার বিনিময়ে ১টি পাসপোর্ট খোরশেদকে দেয়। খোরশেদ ৬৫০ টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট আসামি হাবিবকে দেয়। হাবীব পাসপোর্টের তথ্য ব্যবহার করে জাল বিএমইটি কার্ড তৈরি করে। এরপর ওই জাল বিএমইটি কার্ড খোরশেদ ও বদরুলের হাত হয়ে সুমনের কাছে পৌঁছায়। শাহরিয়ারের নির্দেশে ওই জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নাইমের কাছে পৌঁছে দেয় মো. রিমন সরকার। নাইম ফ্লাইটের আগে ভিক্টিমদের কাছে ওই জাল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড সরবরাহ করে। আর সোহেল স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করে।’
জাল বিএমইটি কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে হাবিব র্যাবকে জানায়, সে মহসিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে খালি কার্ড কিনে আনে। এরপর প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে নিজেই গ্রাফিক্স তৈরি করে। এরপর ভিক্টিমের পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পেছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করে। বদরুলের নির্দেশমতো রিক্রুটিং লাইসেন্সের নম্বর বসিয়ে দিতো সে । চার বছর যাবত ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ডের ডিজাইন ও প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছে হাবিব। ওই অভিজ্ঞতা থেকে সে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছে। এই মানবপাচারকারী চক্র ও বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের ফাঁদে পড়ে ভিক্টিমদের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায় বলেও মন্তব্য করেন র্যাব কর্মকর্তা রাবিকুল হাসান।