এশিয়ার বিখ্যাত কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার (আর পি সাহা) ১২৫ তম জন্মদিন আজ। ১৮৯৬ সালের এই দিনে তিনি সাভারের কাছৈড় গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
আর পি সাহার পৈত্রিক বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। দলিল লেখক বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহা ও মা কুমুদিনী সাহার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
মাত্র সাত বছর বয়সে বিনা চিকিৎসায় মা কুমুদিনী সাহার মৃত্যু হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন রণদা প্রসাদ। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা চরম কষাঘাত নিয়ে অনাদরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন রণদা। অভাবের তাড়নায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে খাবার চেয়ে খেয়েছেন।নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দিনমজুরের কাজ করেছেন।কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে রণদা হয়েছিলেন স্ব-শিক্ষিত।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে রণদা প্রসাদ পাড়ি জমান পাশ্ববর্তী কলকাতায়। সেখানে বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোরে যোগদান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ৩৮ জন সেনাসদস্যকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে বীরত্বগাথা ভূমিকার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসা অর্জন করেন তিনি। এরপর জর্জ ভি নামে এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় সূত্রে রেলওয়ে বিভাগে টিটিই পদে চাকরি নেন তিনি। কিন্ত সহকর্মীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিটিও হারান।
পরে নিজের জমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতাতে প্রথমে লবণ ও পরে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা থেকেই ধীরে ধীরে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ব্যবসায় কিছুটা সফল হওয়ার পর তিনি বেঙ্গল রিভার নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাতে তিনটি পাওয়ার হাউজ ক্রয় করেন। নারায়ণগঞ্জে জর্জ এন্ডারসন কোম্পানির পাটের বেল তৈরি করেন। পরবর্তী সময় তিনি লেদার ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
আর্থিক স্বচ্ছলতা আসার পর ছোট বেলায় বিনা চিকিৎসায় মা কে হারানোর বেদনা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ এলাকা মির্জাপুরে ফিরে আসেন রণদা প্রসাদ। ছেলেবেলার সংকল্পের কথা স্মরণ করে ১৯৩৮ সালে নিজ গ্রাম টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে লৌহজং নদীর তীর ঘেঁষে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ৭৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতালে রূপ নেয়। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে কুমুদিনী হাসপাতাল চত্বরেই নারী শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। পরে সেখানে কুমুদিনী নার্সিং স্কুল, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী সরকারী মহিলা কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মির্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও মির্জাপুর এসকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি।
জীবনসংগ্রামে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হলেও রণদা প্রসাদ বিলাসী জীবন যাপনে অর্থ ব্যয় করেননি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। তার জীবনের অর্জিত সব অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল। এ ট্রাস্টের মাধ্যমেই তার নাতি কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট।
রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন লোকহিতৈষী মানবতাবাদী ও দানবীর। সংস্কৃতির দিকেও তার ছিল বড় ঝোঁক। তিনি প্রায়শই কুমুদিনী চত্বরের আনন্দ নিকেতনে যাত্রাপালাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। যাতে তিনি নিজেও অভিনয় করতেন।
১৩৫০ সালের ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় তিনি লঙ্গরখানা খুলেন। ওই সময় সেখানে হাজার হাজার দরিদ্র লোক প্রতিদিন খাবার খেত। ’৭১-এর ৭ মে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে তাদের নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আজ অবধি তাদের কোন খোঁজ মেলেনি।
এদিকে সোমবার (১৫ নভেম্বর) আরপি সাহার ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নিজ এলাকা মির্জাপুরে নানা কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে প্রভাতফেরি, রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রার্থনা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া সোমবার বিকেলে মির্জাপুর গ্রামবাসী রণদা নাট্যমন্দিরে তার কর্মজীবন ও কীর্তির ওপর আালোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।